ভূমিকা :
গাছপালার জগতে আমিই বড়। আয়তনে ও উচ্চতায় আমি বিশালদেহী। আমার নাম বট গাছ। অথচ আমার জীবনে কত দুঃখ কত কষ্ট। আমার স্থবির অলস জীবন জগতের কোনো কাজে লাগে বলে মনে হয় না। কিন্তু কেন যে মানুষ আমাকে স্মরণ করে তা বলতে পারি না। মানুষের সঙ্গে আমার কোনো সাদৃশ্য নেই। কখন, কোথায় ও কিভাবে আমার জন্ম হয়েছে তাও ঠিক বলতে পারি না। তবে শিশু বয়সে আমার জন্মভূমির যে রূপ দেখেছিলাম, বর্তমান রূপের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই ।
আমার জন্মস্থান :
আমি যে স্থানে জন্মেছিলাম তা জনমানব ও জীবজন্তুর অস্থিত্বহীন কর্দমাক্ত এক টুকরো পতিত জমি। আমার আশেপাশে আরো দুটি চারা গাছ দণ্ডায়মান দেখেছিলাম। কিন্তু সেগুলো আমার শ্রেণিভুক্ত হলেও ঠিক স্বজাতি ছিল না। পণ্ডিতেরা বলেন, জাতিতে আমরা নাকি বৃক্ষ এবং আমাদের পূর্বপুরুষ নাকি শৈবাল জাতীয় জলজ উদ্ভিদ। তাদের কথাটা শুনতে ভালোই লাগে ।
অন্যান্য প্রাণীর সাথে তুলনা :
অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে আমার বড় একটি ব্যবধান নেই। অন্যান্য প্রাণী চলতে পারে, কিন্তু আমি স্থবির, চলতে পারি না। কিন্তু তাই বলে যে, অলস জীবনযাপন করি তা নয়। মানুষের যেমন আহার-নিদ্রা আছে, তেমনি আমারও আহার-নিদ্রা আছে। মানুষের যেমন বংশ বিস্তার হয়ে থাকে, আমারও তদ্রুপ বংশ বিস্তার হয়। আমার বংশ বিস্তারের সহায়ক শক্তি হচ্ছে পাখি। ক্ষুধার্ত হয়ে পাখিরা আমার ডালে আশ্রয় গ্রহণ করে।
আরও পড়ুন : প্রবন্ধ রচনা : একটি নদীর আত্মকাহিনী
আতিথ্য প্রদর্শনে আমিও পশ্চাৎপদ হই না। আমার সামান্য ফল, সুশীতল ছায়া দিয়ে তাদের সেবা করি। কিছু ফল তারা আমার ডালে বসে আহার করে, কিছু ঠোঁটে করে নিয়ে যায়। এ ফল যেখানে পড়ে সেখানেই বংশ বিস্তারিত হয় আমার। এমনকি পাকা স্থান বা পাথরের উপর পড়লেও তা নিষ্ফল হয় না। আর এভাবেই ধীরে ধীরে আমার বংশ বিস্তার ঘটে।
পরার্থপরতা :
কর্মে আমি মানুষের সমকক্ষ। আমার প্রথম এবং প্রধান কাজ পরার্থপরতা। আমার যে সুশীতল ছায়া, তা আমার নিজের বিশেষ কোনো কাজে লাগে না। কিন্তু আমার ছায়া মানুষ এবং জীবজন্তুর বহু উপকারে আসে। আমি আমার প্রশান্ত ছায়া বিস্তার করে কত মুণি-ঋষিকে আশ্রয় দিয়েছি। আমার আশ্রয়ে বসে তাঁরা যে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, আজকের মণিমাণিক্য খচিত অট্টালিকায় বসেও সে জ্ঞান তোমরা অর্জন করতে পার না। আমার কোলে বসেই কতজন কতভাবে উপকৃত হয়েছে। জ্ঞান আহরণ করেছে।
জীবনের দুঃখ দূর করার পন্থা আবিষ্কার করতে বুদ্ধদেব যে সাধনা করেছিলেন, তা আমারই স্বজাতীয় একজনের ছায়ায় বসে। মানব জাতির একাংশ আর্যদের পূর্বপুরুষের সভ্যতা গড়ে উঠেছিল আমাদের সাহায্যেই। পথশ্রান্ত তাপদগ্ধ ঘর্মাক্ত পথিক যখন আমার আশ্রয় প্রার্থনা করে, আমি তখন তাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানাই। আমার ছায়াতলে মৃদু সমীরণ তার ঘাম মুছে ক্লান্তি দূর করে। আমি শুধু মানুষ নয়, অন্যান্য প্রাণীরও সাধ্যমত কিছু না কিছু উপকার করে থাকি। তখন নিজের জীবনকে অনেকটা সার্থক বলে মনে হয়।
আরও পড়ুন : রচনা : কীর্তিময় মিসর / মিসরীয় সভ্যতা
আমি মানুষের জন্য আদর্শ :
মানুষ যদি আমার আদর্শ গ্রহণ করতে পারত, তাহলে পৃথিবী শান্তির নীড় হয়ে উঠত। মনীষীরা আমাকে এবং আমার স্বজাতিকে অমর করে রেখেছেন, কিন্তু মানুষ দিন দিন ভয়ানক স্বার্থপর ও অকৃতজ্ঞ হয়ে উঠছে। এজন্য তারা শান্তি খুঁজে পাচ্ছে না। তারা বুঝেও বুঝতে চায় না যে, তাদের পূর্বপুরুষরা আমাদের থেকে কত উপকার পেয়েছিল।
কিন্তু হায়। আজ তারা নির্বিচারে আমার ও আমার জাতির নিধনযজ্ঞ সাধন করে সে স্থানে গড়ে তুলছে বড় বড় অট্টালিকা! আমরা যে নির্দোষ এবং অসহায়, আমাদের দ্বারা তাদের উপকার ছাড়া যে অপকার মোটেই হয় না, তা তারা একবারও ভেবে দেখতে চায় না। এসব ভাবলে তখন খুব কষ্ট অনুভূত হয়। তখন কাউকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারি না ।
উপসংহার :
আমার মনে অনেক কষ্ট। কিন্তু কেউই আমার এ কষ্ট বুঝতে চায় না। আমার কাছ থেকে উপকার পেয়েও আমার ক্ষতি করে চলেছে। তারা আমার ডালপালা, পাতা ভেঙে নিয়ে যায়, তবুও নিজেকে সান্ত্বনা দেই, জীবন মানেই আনন্দ, জীবন মানেই দুঃখ। এভাবেই চলছে আমার জীবন।