রচনা : যুব সমাজের অবক্ষয় ও তার প্রতিকার

ভূমিকা : 

আজকের তরুণ আগামীদিনের ভবিষ্যৎ, দেশ ও জাতির কর্ণধার । এ তরুণদের সত্য, সঠিক, সুন্দরভাবে গড়ে তোলার মধ্যেই দেশের কল্যাণ নিহিত । আর এ যুব বা তরুণ সমাজের বিপথগামিতার অর্থ দেশের অনিবার্য বিপদ কারণ তরুণদের নিকট জাতির আবেদন- “চিরযুবা, তুই যে চিরজীবী, জীর্ণ জরা ঝরিয়ে দিয়ে, প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দেদার দিবি।” কিন্তু আমাদের সমাজ নানা রোগে আক্রান্ত । আর যুব সমাজ এ রোগের শিকার । যুব সমাজ আজ পথভ্রষ্ট হয়ে অধঃপতন এবং ধ্বংসের দিকে অগ্রসরমান। তাদের এ অধঃপতনের হাত থেকে বাঁচিয়ে আনা এখন জাতীয় দায়িত্বে পরিণত হয়েছে।

যুব সমাজ ও অবক্ষয় : 

যুগে যুগে ন্যায় ও সত্যের জন্য সংগ্রাম করে যারা জীবন উৎসর্গ করে, নবজীবনের সঙ্গীত রচনার ভার যাদের উপর তারাই যুবক। যারা বয়সে নবীন, মন যাদের বিশ্বাসে ভরপুর, যাদের চোখে ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন, যারা অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না, পুরাতনকে ভেঙেচুরে নতুন কিছু গড়তে চায়, তারাই তরুণ । তারুণ্য স্থবির নয়, সে সদা চঞ্চল । সে পরাজয় মানতে নারাজ । তারা দেশ ও জাতির গৌরব। কিন্তু এ তরুণ বা যুব সমাজই যখন খারাপ পথে পা বাড়ায়, তখন তা জাতির জন্য ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। তাদের বিপথগামিতার কারণে জাতীয় জীবনে নেমে আসে চরম অন্ধকার। 

আরও পড়ুন : রচনা : মাদকাসক্তি ও এর প্রতিকার - ২০ পয়েন্ট 

অবক্ষয়ের কারণ : 

আমাদের সমাজ নানা অবক্ষয়ের শিকার । এ অবক্ষয় যুব সমাজের চিত্তেও দোলা দিয়েছে। নীতি যেখানে পদদলিত, অসৎপথে অবৈধ অর্থের পাহাড় যেখানে গড়ে উঠে, বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে য়ে সমাজে কাঁদে, সে সমাজে নৈতি মূল্যবোধ ধূলায় গড়াগড়ি খায়। আমাদের যুব সমাজ আজ নানা কারণে ধ্বংসের মুখোমুখি । বেকারত্ব, সন্ত্রাস, রাজনৈতিক কুপ্রভাব অপসংস্কৃতি, অর্থনৈতিক দৈন্য ইত্যাদি যুব সমাজকে দারুণভাবে প্রভাবান্বিত করছে। ফলে তারা সুস্থ জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঝুঁকে পড়ছে নানা অবক্ষয়ের দিকে । নিম্নে যুব সমাজের অবক্ষয়ের কারণ দেয়া হল--

অপসংস্কৃতির প্রভাব : 

যুব সমাজের উপর সিনেমা, টেলিভিশন, সংবাদপত্র ইত্যাদির কুপ্রভাব অত্যন্ত বেশি। সিনেমার কাহিনী, নাচ-গান, পোশাক-আশাক ইত্যাদি এমনভাবে সন্নিবেশিত যে তাতে তরুণ সমাজ সস্তায় ও সহজে আমোদ-প্রমোদের উপকর খুঁজে পায় । তরুণ-তরুণীরা সিনেমায় এ সব উদ্ভট ও অবাস্তব কাহিনীকে অনেক সময় বাস্তব জীবন বলে মারাত্মক ভুল করে এবং এগুলো অন্ধভাবে অনুকরণ করে । টিভিতেও অনেক সময় যুব সমাজকে আনন্দদানের জন্য সস্তা ও ধ্বংসাত্মক অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। বিশে করে টিভির বিজ্ঞাপনগুলো যুব সমাজকে ভোগ ও বিলাসিতার দিকে আকৃষ্ট করে তোলে । তাছাড়া ভি সি আর এর মাধ্যমে অশ্লীল ছবি প্রচার করেও যুব সমাজের নৈতিক অবক্ষয় ঘটানো হয় ।

সংবাদপত্রের ভূমিকা : 

অপসংস্কৃতি প্রচারের আর একটি মাধ্যম হচ্ছে সংবাদপত্র । অধিকাংশ সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক পত্রিকায় নগ্নছবি, যৌনাবেগ সম্পর্কে কথিকা ইত্যাদি প্রকাশ করে তরুণ-তরুণীদের অবক্ষয়ের পথ সুগম করে । তাছাড়া খুন-জখম, চুরি- ডাকাতি, গুণ্ডামি-রাহাজানি ইত্যাদির ডালি সাজিয়ে সংবাপত্র যে নৈবেদ্য পরিবেশন করে তাও যুব সমাজের মানুষিক চিন্তাকে প্রভাবান্বিত করে।

আরও পড়ুন : বাংলাদেশের বেকার সমস্যা ও তার প্রতিকার : বাংলা রচনা  

মাদকদ্রব্যের ভূমিকা : 

কোন দেশের যুব সম্প্রদায় মাদকাসক্ত হওয়ার অর্থ হচ্ছে সে দেশের নৈতিক চরিত্রের দেউলিয়াপনা ও অনিবার্য অধঃপতন। গাঁজা, ভাং, আফিম, হেরোইন, প্যাথেড্রিন, কোকেন, এলএসডি, হাশিস, মারিজুয়ানা ইত্যাদি নানা ক্ষতিক মাদকদ্রব্য আজ সর্বত্রই পাওয়া যায় । আর উঠতি যুবক-যুবতীরা এ সুযোগ গ্রহণ করে জীবনকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে।

রাজনৈতিক দলের কুপ্রভাব : 

রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য তরুণদের দলে টানতে গিয়ে অনেক সময় বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন । রাজনীতিবিদগণ তরুণদের তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন । নেতারা তরুণদে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে কুপথে পরিচালিত করেন। এমনকি তারা যুব সমাজকে দিয়ে ভোট ডাকাতি, লুট, হাইজ্যাক, গুন্ডামি করাতে দ্বিধাবোধ করেন না । যার পরিণাম যুব সমাজের জন্য খুবই মারাত্মক হয় 

বেকারত্ব : 

যুব সমাজের বিপথগামিতার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে বেকারত্ব। তরুণ-তরুণীরা পড়ালেখা ছাড়া কোন কাজ পায় না। তারা বাবা-মায়ের উপরও নির্ভর করতে পারে না । চাকরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তারা অসৎ পন্থায় উপার্জনে নামে । তখন তারা চুরি ডাকাতি, খুন, রাহাজানি, ছিনতাই, অপহরণ ইত্যাদি জঘন্য অপরাধ করতেও দ্বিধা করে না। এভাবেই বেকার তরুণ-তরুণীরা জীবসম্পর্কে হতাশাগ্রস্ত হয়ে নানা অপরাধে লিপ্ত হয় ।

শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস : 

শিক্ষাক্ষেত্রে অব্যবস্থাও অনেক সময় যুব সমাজকে বিপথগামিতায় ইন্ধন জোগায় । ভর্তির সমস্যা, বইয়ে সমস্যা, ফল প্রকাশে অযথা বিলম্ব, যখন-তখন ধর্মঘট ইত্যাদি তরুণদের মানসিক জগতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। তাছাড়া শিক্ষাঙ্গে মারামারি, বোমাবাজি লেগেই আছে। গুটিকয়েক সন্ত্রাসী সমস্ত ছাত্র সমাজকে সন্ত্রাসের মাধ্যমে জিম্মি করে রেখেছে। আর এর শিকা হচ্ছে আমাদের যুব সমাজ। নকল করে পাস করার প্রবণতাও ছাত্র সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

আরও পড়ুন : বাংলা প্রবন্ধ রচনা - সন্ত্রাস 

প্রতিকার : 

যুব সমাজকে সুপথে ফিরিয়ে আনা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে । আর এ দায়িত্ব পালনের ভার সমাজে সচেতন মহলকে অবশ্যই নিতে হবে। এ ব্যাপারে জাতীয় প্রচার মাধ্যমগুলো তথা টিভি, সিনেমা ও পত্র-পত্রিকাগুলোকে গঠনমূলক হতে হবে। তরুণ সমাজের জন্য রীতিমত খেলাধূলা ও শরীর চর্চার ব্যবস্থা করতে হবে। নিষ্কলুষ চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে তাদের মুক্ত করতে হবে। 

শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সঠিক পরিবেশ অবশ্যই ফিরিয়ে আনতে হবে। যুবকদে ধর্মশিক্ষায় অনুপ্রাণিত করতে হবে। সকল প্রকার মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। অপরাধীকে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। তাদে কণ্ঠে উচ্চারিত হবে কবি নজরুলের সেই বিখ্যাত বাণী—“ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত, আমরা আনিব রাঙা প্রভাত আমরা টুটাব তিমির রাত, বাধার বিন্ধ্যাচল ।” আর তাহলেই আমাদের যুব সমাজের অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব ।

উপসংহার : 

তরুণরাই হচ্ছে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক । তাদের বিপথগামিতার অর্থ সমস্ত জাতির জন্য মারাত্মক বিপদ তাই দেশ ও জাতির কল্যাণে তাদের রক্ষা করতেই হবে। তাদের তারুণ্যকে সৎ ও সঠিক পথে পরিচালিত করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে । তাহলেই আমরা বিশ্ব দরবারে স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব । তাদের নিকট আমাদের বাণী হচ্ছে— “ওরে তরুণ, ওরে কাঁচা, আধ-মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা ।”

আরও পড়ুন : প্রবন্ধ রচনা : ইসলামী সাহিত্য

Post a Comment

0 Comments

Bottom Post Ad