ভূমিকা
বাংলাদেশের মতো নদীমাতৃক দেশে নৌকাভ্রমণ একটি আনন্দদায়ক বিষয় । নৌকাভ্রমণের মাধ্যমে নদীকে যেমন কাছ থেকে চেনা যায় তেমনি দুপাড়ের জনজীবন সম্বন্ধে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করা যায়। এছাড়া আরও উপভোগ করা যায় নদীকেন্দ্রিক প্রকৃতির অবারিত সৌন্দর্য ।
নৌকায় ভ্রমণের কারণ
গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ি জেলার গোয়ালন্দে হওয়ায় ছোটো থেকেই চোখের সামনে প্রমত্ত পদ্মা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নজরুলের অসাধারণ এক গান- 'পদ্মার ঢেউ রে; মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যারে।' এ গানই যেন 'পদ্মার বুকে আমাকে টেনে নিয়ে আসত।
মন চাইত ছোট্ট একটি নৌকা নিয়ে পদ্মার বুকে হারিয়ে যাই। কিন্তু বয়স কম থাকায় আর সাঁতারে কাঁচা হওয়ায় পদ্মায় নৌকা ভ্রমণের সুযোগ আমার হয়নি। অবশেষে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বাড়ির সবাইকে বুঝিয়ে আমি পদ্মায় নৌকা ভ্রমণের অনুমতি পাই। অপেক্ষা করতে থাকি নির্দিষ্ট সেই দিনের জন্যে।
ভ্রমণের পূর্বপ্রস্তুতি
বার্ষিক পরীক্ষার পর অবসরই ছিল নৌকাভ্রমণের আদর্শ সময়। এ সময় নদীতে তেমন স্রোত থাকে না; তাছাড়া মাছ ধরার তেমন ভিড়ও থাকে না। ভ্রমণের আগের দিন আমি ভীষণভাবে উৎফুল্ল ছিলাম; যদিও বাড়ির সবাই বেশ চিন্তায় ছিল। তাদের চিন্তা নিরসন করতে আমার গ্রামের বাড়ির সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হুসাইনকে সাথে নিলাম।
আরও পড়ুন :- রচনা : এই দেশ এই মানুষ / প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ
হুসাইন ছিল সুস্বাস্থ্যের অধিকারী; তাছাড়া ও খুব ভালো সাঁতার জানত। ওকে সঙ্গে নেওয়াতে বাড়ির সবাই বেশ আশ্বস্ত হলো। প্রচুর শুকনো খাবার, ফ্লাক্স ভর্তি চা, একটি ডিজিটাল ক্যামেরা, মাথায় দেওয়ার ছাতাসহ একটি বড়ো ট্রাকের টিউব নিয়ে নিলাম। যদি কোনো দুর্ঘটনায় পড়ি টিউবটি আমাদের ভেসে থাকতে সাহায্য করবে।
ভ্রমণের যাত্রাপথ
চারঘাটের খেয়া পারাপার ঘাট থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। মতিন চাচা এ অঞ্চলের খুব অভিজ্ঞ ও নির্ভরযোগ্য একজন মাঝি। তার নৌকা আমরা ভ্রমণের জন্য ঠিক করেছিলাম। গোয়ালন্দ ঘাট থেকে আমরা যাব পাটুরিয়া ঘাটে। একসময় ওই ঘাঁটে বড়ো বড়ো নৌকা ভিড়ত ৷ তাছাড়া সেখানে পদ্মা বেশ গভীর ও স্বচ্ছ। চাচা বললেন, আমাদের যেতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লেগে যাবে। তবে ফিরতে সময় লাগবে আরও বেশি কারণ তখন আমরা স্রোতের বিপরীতে থাকবো। ঠিক বেলা দশটায় আমরা যাত্রা শুরু করলাম ।
নদীতে সূর্যাস্ত
বাঘার ঘাটে পৌঁছে মতিন চাচা ও আমরা অনেকক্ষণ বিশ্রাম করলাম। তারপর আবার রওনা হলাম আমরা। মতিন চাচা নৌকার পাটাতনের ভেতর থেকে একটি চার্জার লাইট বের করলেন। আমি দেখে হেসে ফেললাম । তিনি বললেন, একসময় সব নৌকায় হারিকেন জ্বলত, কিন্তু এখন আর কেউ হারিকেন ব্যবহার করে না।
কিছুদূর আসতেই সূর্যাস্ত নেমে এলো নদীর বুকে। পশ্চিম দিক লাল রঙে সজ্জিত হলো। পাখিরা ফিরতে থাকল ঘরে। নৌকাগুলোও আস্তে আস্তে পাড়ে ভিড়তে থাকল। কিন্তু বৈদ্যুতিক বাতির কল্যাণে নদীর ধারের ইলেকট্রিক খুঁটিগুলো জ্বলে উঠল। অন্ধকারের নিস্তব্ধতা যেন ভেঙে গেল ওই সময়ে।
আরও পড়ুন :- একটি ঝড়ের রাত - বাংলা প্রবন্ধ রচনা
নদীতে রাত্রিকালীন সময়
সূর্যাস্তের পর পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদ আকাশে ভেসে উঠল। নদীর জলে সেই চাঁদের প্রতিচ্ছায়া পড়ল। আমি আর হুসাইন জলে ঢেউ দিতে থাকলাম আর আকাশের চাঁদটা যেন তার কিরণ আরও বিচ্ছুরিত করতে লাগল। চারদিক চাঁদের আলোয় ভরে গেছে ততক্ষণে। মতিন চার্চাকে একটি গান ধরতে বললাম। প্রথমে তিনি একটু সংকোচ করলেন; তারপর ধীর গলায় ধরলের 'সোয়াচান পাখি.... আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি।'
ভ্রমণের সমাপ্তি
আমরা ফিরে এলাম আমাদের যাত্রা শুরুর স্থানে। কিছু খাবার-দাবার বেঁচেছিল। মতিন চাচার হাতে দিয়ে বললাম বাড়িতে নিয়ে যেতে। তিনি চলে গেলেন, কিন্তু কিছুতেই আমার মন নদীর পাড় থেকে নড়ছিল না। ডিজিটাল ক্যামেরা থেকে বার বার তোলা ছবিগুলো দেখছিলাম। আর আমার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছিল মুহূর্তগুলো। মনটা উদাস হয়ে গেল; আমি আর হুসাইন ফিরে এলাম বাড়িতে।
উপসংহার
আমার সমস্ত জীবনে হয়তো নৌকাভ্রমণের সেই দিনটির স্মৃতি বা অভিজ্ঞতা অমলিন হয়ে থাকবে। নদীর ধারে আমার জীবনের অনেক সময় কে টেছে। কিন্তু তাতে নদীর প্রতি আমার আকর্ষণ এতটুকুও কমেনি। বরং বার বার আমি নদীর বুকে ফিরে যেতে চেয়েছি। মতিন চাচার নৌকায় বেড়াতে চেয়েছি বার বার । কিন্তু ওই সুযোগ আমার আর হয়নি। জীবন তার অন্য পাঠ আমাকে দিয়ে পড়িয়েছে। তবে মুছে দিতে পারেনি নৌকাভ্রমণের সেদিনের সেই অভিজ্ঞতা ।
আপনার পছন্দ হতে পারে এমন আরও পোস্টের তালিকা