প্রবন্ধ রচনা : এইডস ও তার প্রতিকার

উপস্থাপনা : 

রোগ-ব্যাধি মানুষের নিত্যসঙ্গী। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী এইডস জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কোনো প্রাণীর দেহে প্রাণের অস্তিত্বের পাশাপাশি অবস্থান করছে কোনো না কোনো রোগ-ব্যাধি। তবু অনাদিকাল থেকে মানুষ রোগ- ব্যাধির সাথে লড়াই করে পৃথিবীতে টিকে আছে। রোগ নিরাময়ের জন্য আবিষ্কার করেছে ওষুধ, গড়ে তুলেছে প্রতিরোধ ব্যবস্থা। কিন্তু বিজ্ঞানের এ চরম সাফল্যের যুগেও মানুষকে থমকে দিয়েছে যে রোগটি, তা হলো ঘাতক ব্যাধি 'এইডস'। 

নিশ্চিত মৃত্যু যার পরিণতি। ১৯৫৯ সালে প্রথম ব্রিটেনের এক ব্যক্তির রক্তে এইডস ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া যায়। যৌনমিলন কিংবা রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমেই এটা মানবদেহে সংক্রমিত হয়। এর কোনো কার্যকর ওষুধ আজো আবিষ্কৃত হয়নি। তাই বিশ্ব মানবসমাজ এর ভয়ে আতঙ্কিত। 

এইডস কী : 

'এইডস (AIDS) একটি সংক্ষিপ্ত ইংরেজি শব্দ। এর পূর্ণ নাম "Acquired Immune Deficiency Syndrome" এ রোগের ভাইরাসকে বলা হয় "Human Immune Deficiency Virus" সংক্ষেপে HIV ।

ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে এবং একসময় জীবন নিঃশেষ হয়ে যায়।ফলে মানুষ পতিত হয় নিশ্চিত মৃত্যুমুখে। সর্বপ্রথম মার্কিন চিকিৎসাবিজ্ঞানিগণ এ রোগের ভাইরাস আবিষ্কার করে। আশির দশকে এ রোগের প্রাদুর্ভাব প্রথম আফ্রিকা মহাদেশে দেখা গিয়েছিল। অনেক চিকিৎসকের ধারণা, এক প্রজাতির সবুজ বানরের মাধ্যমে এ রোগের উৎপত্তি হয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে এ জাতীয় বানরের মধ্যে এইচআইভি পাওয়া গেছে।

আরও পড়ুন :- রচনা : যুব সমাজের অবক্ষয় ও তার প্রতিকার

এইডস-এর কারণ : 

মহামারী এইডস-এর প্রধান কারণ হচ্ছে অবাধ যৌনাচার। যৌন বিষয়ে অসংযমী লোকদের মধ্যেই এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। বহুগামিতা, বিকৃত যৌনাচার, পুং ও পশুমৈথুন ইত্যাদি কারণেও এ রোগের উৎপত্তি ঘটে। এইডসে আক্রান্ত কোনো নারী বা পুরুষের রক্ত শরীরে গ্রহণকারীও এইডসে আক্রান্ত হয়। রক্ত পরিসঞ্চালনে বা মাদক ব্যবহারে একই সিরিঞ্জ একাধিক ব্যক্তি গ্রহণ করলে HIV সংক্রমন হতে পারে। মূলত এইডসে আক্রান্ত নারী-পুরুষের সাথে দৈহিক মিলনের মাধ্যমেই এ রোগের বিস্তার ঘটে। তাই একে প্রধানত যৌনবাহিত রোগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এইডস আক্রান্ত মায়ের গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারী শিশুও এ রোগ সঙ্গে নিয়ে পৃথিবীতে আসে।

এইডস-এর উপসর্গ : 

এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে বিভিন্ন উপসর্গ প্রকাশ পায়। হঠাৎ করে শরীরের ওজন ১০ শতাংশের বেশি কমে যাওয়া, এক মাসের বেশি সময় ধরে ডায়রিয়া থাকা এবং দীর্ঘদিন যাবৎ শরীরে জ্বর থাকা এইডস-এর প্রধান লক্ষণ। এছাড়া এইডসে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে শুকনো কাশি, পেটের পীড়া, চর্মরোগ, শরীরে ঘা-পাঁচড়া, শিরা ফোলা, ক্লান্তি, কৃমি, নিউমোনিয়া, মস্তি $ প্রদাহ ইত্যাদি উপসর্গ লক্ষ করা যায়। রক্তের এইচআইভি পরীক্ষার মাধ্যমে দেহে এইডস-এর উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। রক্ত ছাড়াও এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির বীর্য, মুখের লালা, মহিলাদের জরায়ু থেকে নিঃসরিত গ্রন্থিরস এবং বুকের দুধ পরীক্ষা করেও এইচআইভি-র উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়।

এইডস-এর বিস্তার : 

সুদূর আফ্রিকা থেকে মাত্র এক দশকের ব্যবধানে এইডস দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। এ রোগ বিস্ত ারের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে যৌনাচার। এর মাধ্যমে আফ্রিকা, আমেরিকা, রাশিয়া, ইউরোপ মহাদেশ ও ভারতসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এমনকি আমাদের বাংলাদেশেও এইডস বিস্তার লাভ করেছে। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত কতিপয় ব্যক্তিই এদেশের এইডস রোগের জীবাণু বহন করে এনেছে। 

আরও পড়ুন :- রচনা : দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও তার প্রতিকার - PDF

যেসব দেশে হোমোসেক্স বা সমকামিতার প্রচলন বেশি এবং বহুগামিতার সুযোগ অবারিত সেসব দেশেই এ রোগ ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মায়ারমারসহ চীন, কম্বোডিয়া, থাইল্যাণ্ড প্রভৃতি দেশে এইডস ছড়িয়ে পড়েছে মহামারী আকারে। দক্ষিণ আফ্রিকার শতকরা ১১ ভাগ মানুষ এইডস আক্রান্ত। এইডস এদেশটিকে ভয়াবহ আর্থ-সামাজিক সংকটের মধ্যে নিপতিত করেছে।

এইডস-এর চিকিৎসা : 

প্রকৃতপক্ষে এইডস কোনো একক রোগ নয়। এইচআইভি সংক্রমণের পর রোগীর দেহে অসংখ্য রোগের সংক্রমণ ঘটে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস হয়ে যায়। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগেও মানুষের চরম ব্যর্থতা হলো, এখনো পর্যন্ত এ রোগের কোনো সুষ্ঠু চিকিৎসা উদ্ভাবন করা যায়নি। এইডস-এর প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানীরা নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু এক্ষেত্রে সাফল্য এখনো আশাপ্রদ নয়। তাই চিকিৎসার বদলে রোগমুক্ত থাকাটাকেই অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশে এইডস-এর ঝুঁকি : 

বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ২৮৭১ জনের মতো লোক HIV-তে সংক্রমিত হয়েছে। এর মধ্যে AIDS-এ আক্রান্ত হয়েছে ১২০৪ জন। মৃত্যু হয়েছে ৩৯০ জনের। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বাংলাদেশের সামাজিক মূল্যবোধ ও জীবনাচার এইডস সংক্রমণের জন্য সহায়ক নয়। তবে বাংলাদেশ তিন দিক দিয়ে ভারত দ্বারা বেষ্টিত, যেখানে বর্তমানে এইডস ছড়িয়ে পড়েছে প্রায় মহামারী আকারে। প্রতিবেশী মায়ানমারেও এইডস রোগের প্রকোপ রয়েছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ কর্ম ও ব্যবসাসূত্রে বিদেশে গমনাগমন করে থাকে। ফলে আমাদের দেশ ভয়াবহ এইডস ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

আরও পড়ুন :- বাংলা প্রবন্ধ রচনা : ডেঙ্গু জ্বর । PDF

আমাদের দেশে এইডস সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি : 

এইডস একটি রোগ। এ রোগে আক্রান্ত সকলেই যে বিকৃত জীবনযাপন ও অবাধ যৌনাচারে অভ্যস্ত, তা নয়। নানাভাবে এ রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। তবু আমাদের দেশে হতভাগ্য এইডস রোগীদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক নয়। রোগীদের প্রতি সহানুভূতির বদলে তাদেরকে এড়িয়ে চলা হয়। অনেক সময় এইচআইভি সংক্রমণ ধরা পড়ার পর রোগীকে চিকিৎসা গ্রহণের বদলে আত্মগোপন করতে হয়। প্রিয়জনরাও ছেড়ে চলে যায় হতভাগ্য রোগীদেরকে। ফলে এইডস রোগীর প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ করা দুরূহ। এ রোগ সম্পর্কে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আবশ্যক ।

প্রতিকার : 

এইডস রোগ প্রতিকারের কার্যকর ওষুধ এখনো আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। তবে নিম্নোক্ত উপায়ে তা প্রতিরোধ করা
যেতে পারে-
১. যৌনমিলনের ক্ষেত্রে সংযমী হওয়া এবং অবাধ যৌনাচার থেকে বিরত থাকা।

২. পতিতালয়ে গমন, সমকামিতা এবং পশুর সাথে যৌনাচার প্রভৃতি অসঙ্গত আচরণ থেকে বিরত থাকা ।

৩. ধর্মীয় অনুশাসন বিশেষ করে ইসলামের বিধিবিধান মেনে চলা এবং সেই অনুযায়ী সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপন করা।

৪. বিদেশ থেকে আগত প্রত্যেকটি লোকের স্বাস্থ্য পরীক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা।

৫. গৃহীত রক্তে এইডস রোগের ভাইরাস আছে কি-না, রক্ত গ্রহণকালে তা নিশ্চিত হওয়া।

৬. ইঞ্জেকশন নেয়ার সময় অবশ্যই ডিসপোজ্যাবল সিরিঞ্জ ব্যবহার করা।

৭. কারো ব্যবহৃত ক্ষুর বা ব্লেড ব্যবহার না করা।

৮. এইডসে আক্রান্ত মায়ের ক্ষেত্রে শিশুকে বুকের দুধ পান না করানো ।

৯. স্বামী বা স্ত্রী HIV সংক্রমিত হলে যৌনমিলনে নিরাপদ ব্যবস্থা অবলম্বন করা।

১০. সর্বোপরি এইডস রোগের বিস্তার এবং পরিণতি সম্পর্কে সচেতন থাকা।

উপসংহার : 

এইডস রোগের ভয়াবহতা আমাদেরকে এ কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ধর্মীয় বিধানের পরিপন্থী কোনো অনুশীলন মানুষের জন্য কখনো কল্যাণকর হতে পারে না। তাই মরণব্যাধি এইডস-এর ভয়াবহ ছোবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য নীতিবিগর্হিত সকল কাজ পরিহার করে ধর্মীয় জীবনযাপন করতে হবে। পাশাপাশি, এ রোগ বিস্তারের অন্য কারণগুলো চিহ্নিত করে নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোর সকলকেই সেগুলো বর্জন করতে হবে। 

ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। অন্যথায় জাতীয় জীবনে নেমে আসবে মারাত্মক বিপর্যয়। বিজ্ঞানীরা নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু এক্ষেত্রে সাফল্য এখনো আশাপ্রদ নয়। তাই চিকিৎসার বদলে রোগমুক্ত থাকাটাকেই অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে।

Post a Comment

0 Comments