প্রবন্ধ রচনা : হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী

ভূমিকা : 

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে একজন অন্যতম সফল রাজনীতিবিদ। মুসলিম নেতা হিসেবে উপমহাদেশের রাজনীতিতে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।

জন্ম ও বংশ পরিচয় : 

১৮৯২ সালে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা স্যার জাহিদ সোহরাওয়ার্দী কলিকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে আর্টস ফ্যাকালটির ডীন নিযুক্ত করে তাঁর পাণ্ডিত্যকে সম্মানিত করেছিল। সোহরাওয়ার্দী পরিবারের আদি নিবাস ছিল বাগদাদে। মোগল আমলের শেষ দিকে তাঁরা ভারতবর্ষে আসেন এবং পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলায় বিরাট ভূসম্পত্তি লাভ করেন। পরে ইংরেজরা যখন কলিকাতা নগর প্রতিষ্ঠা করে, তখন সোহরাওয়ার্দী পরিবার কলিকাতায় এসে বসবাস করতে থাকেন ।

শিক্ষাজীবন : 

কলিকাতা মাদ্রাসায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পাঠ্যজীবন আরম্ভ হয়। এখান থেকে পাস করে তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে প্রবেশ করেন এবং বি. এস. সি. পাস করে লন্ডনে যান। অক্সফোর্ড থেকে তিনি এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর আইনে অনার্স এবং আইন শিক্ষার সর্বোচ্চ পর্যায় বিসি. এল. পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করেন। ১৯১৮ সালে তিনি লন্ডনে গ্যারেজ-ইন-এ যোগদান করেন। অক্সফোর্ডে ছাত্র থাকাকালে তিনি অক্সফোর্ড ছাত্র সংঘের সভাপতি হওয়ার গৌরব লাভ করেন।

আরও পড়ুন : রচনা : শেরে বাংলা একে ফজলুল হক

কর্মজীবন : 

স্বদেশে ফিরে এসে তিনি কলিকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায় শুরু করেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ছাব্বিশ বছর। ১৯২১ সালে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯২৩ সাল থেকে শুরু করে কয়েক বছর পর্যন্ত এ সভার ডেপুটি প্রেসিডেন্টের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হয়ে সভার ভেতরে-বাইরে মুসলিম স্বার্থের জন্য একনিষ্ঠ সংগ্রাম করে গেছেন। এ সময় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্বরাজ পার্টি প্রদেশের সর্বত্র অপ্রতিহত প্রভাবে বিরাজ করছিল। তিনি দেশবন্ধুর সঙ্গে মিলিত হয়ে স্বরাজ পার্টির সঙ্গে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এ চুক্তির শর্ত হলো জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলার মুসলমানগণকে রাজনৈতিক স্বীকৃতি দান ।

দাস ও শহীদ কোয়ালিশন দল কলিকাতা নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক ভোটে জয়ী হয়ে নগরবাসীর বিস্ময় সৃষ্টি করেন এবং সি. আর দাস মেয়র এবং শহীদ সাহেব ডেপুটি মেয়র হন। এ সময় বাংলার বীর সন্তান নেতাজী সুভাষ চন্দ্র স্বেচ্ছায় কর্পোরেশনের এক্‌জিকিউটিভ অফিসারের কর্মভার গ্রহণ করেন। ১৯২৬ সালে সর্বপ্রথম কলিকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাধে। দাঙ্গার পর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলে ৫০ জন মুসলমান ও এক জন হিন্দু অভিযুক্ত হয়। এ ৫০ জন মুসলমানের পক্ষে তিনি ওকালতি করেন।

৪৯ জনকে তিনি মুক্ত করেন, কিন্তু এক জনের ফাঁসির হুকুম হয়। তিনি তাকে ফাঁসি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। তার পক্ষে হাইকোর্ট ও প্রিভি কাউন্সিলে লড়েও তার ফাঁসির হুকুম রদ করাতে সমর্থ হননি। পরে তিনি গভর্নর বাহাদুরের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে গভর্নর আসামির প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করেন।

আরও পড়ুন : রচনা : হাজী মুহাম্মদ মহসীন 

১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাস পরলোকগমন করলে তাঁর সঙ্গে শহীদ সাহেবের যে চুক্তি হয়েছিল, তা আর টেকেনি। সুতরাং চুক্তিটি বাতিল হয়। ১৯২৮ সালে পুনরায় বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করেন। জয়ী হয়ে তিনি পরিষদে স্বতন্ত্র মুসলিম পার্টি গঠন করেন। এ সময় জনাব মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগ পুনর্গঠন করে তার প্রচারকার্যের জন্য সমগ্র ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করতে শুরু করেন। তিনি সোহরাওয়ার্দীকে দলে টানতে চাইলেন। কারণ এ সময় শেরে বাংলা ছিলেন চরম মুসলিম লীগ বিরোধী। তিনি ছিলেন কৃষক প্রজা পার্টির কর্ণধার। শহীদ সাহেব জিন্নাহর অনুরোধে মুসলিম লীগে যোগ দেন ।

১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত শহীদ সাহেব বঙ্গীয় মুসলিম লীগের একমাত্র অধিনায়করূপে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালে কলিকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাধে। এতে বহু লোক হতাহত হয়। তখন তিনি ছিলেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী। এ দাঙ্গা থামানোর জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন।

১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলে জিন্নাহ সাহেব তাঁকে পাকিস্তানে আসার জন্য অনুরোধ জানান। ১৯৫৬ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।

মৃত্যু : 

১৯৬২ সালে তাঁকে পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। করাচী জেলে থাকাকালে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। জেলে থেকে মুক্তি পাওয়ার পর চিকিৎসার জন্য তিনি জুরিখে চলে যান এবং সেখান থেকে লন্ডনে যান। সুস্থ হয়ে স্বদেশে ফেরার পথে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে অবস্থানকালে ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৩ মৃত্যুবরণ করেন।

উপসংহার : 

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু চির স্মরণীয় এবং অনুকরণীয় হয়ে আছে তাঁর বিভিন্ন নির্দেশনা। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম নেতাদের মাঝে তাঁর নাম চির অমর হয়ে থাকবে।

Post a Comment

0 Comments