একটি স্মরণীয় ঘটনা - রচনা

ভূমিকা :

মানবজীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা কোনোদিন ভোলা যায় না। এমন একটি ঘটনা আমার বাবার জীবনেও স্মরণীয় হয়ে আছে। ঘটনাটি অত্যন্ত লোমহর্ষক। তিনি আমাকে তাঁর জীবনের সেই ঘটনা একদিন বর্ণনা করেন।

ঘটনার বিবরণ : 

বাবার বর্ণনায় ফুটে ওঠে ঘটনাটি এভাবে— সেদিনের সে ভয়াল স্মৃতি মনে হলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়। ১৯৭১ সাল । সারা দেশে ভয়াবহ অবস্থা। পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাকাণ্ড, নারীনির্যাতন ও ধ্বংসলীলার তাণ্ডব চলছে। ক্রমান্বয়ে তারা বড় শহর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে মফস্বল শহরে । হঠাৎ শুনলাম তারা আমাদের পিরোজপুর শহরে এসে গেছে । 

প্রতিদিন তাদের অত্যাচারের লোমহর্ষক ঘটনায় সবাই ভীত হয়ে উঠতে থাকে । শহর ছেড়ে পাকিস্তানি সেনারা গ্রামেও নেমে গেছে । তারা নির্বিচারে সাধারণ মানুষকে মারছে। নারীদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছে। ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে। এক ভয়াল রাহুগ্রাস যেন আমাদের চারদিক থেকে ধেয়ে আসছে। সবাই উদ্বিগ্ন ৷

আরও পড়ুন :- আমার দেখা একটি মেলা - রচনা : class 6, 7, 8

৭ই মে ১৯৭১। ওই দিনটি আমার মনে সবচেয়ে দাগ কেটে আছে। আমি তখন প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র। দুপুরে নদীতে গোসল করতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ কে যেন বলে উঠল, মিলিটারিরা বাজারে আগুন দিয়েছে। ছুটে এলাম বাড়িতে। ভয়ে সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। সবাই পালাতে ব্যস্ত। আমি দৌড়ে গেলাম বাড়ির পূর্বদিকের মাঠের ধারে একটি জঙ্গলের কাছে। 

সেখানে গিয়ে দেখি ডা. অতুল অধিকারী দাঁড়িয়ে। আমি তাঁর সামনে দাঁড়াতেই তিনি বলে উঠলেন, জানি না কার ভাগ্যে কী আছে? কে জানে কে বাঁচবে আর কে মরবে? হঠাৎ লঞ্চের শব্দ ভেসে আসে। আমরা জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়ি। এমন সময় একটি লোক হামাগুড়ি দিয়ে আমাদের কাছে এল । সে দেখে এসেছে পুলের কাছে পাকিস্তানি পতাকাশোভিত লঞ্চ ভিড়েছে। 

লোহার টুপি মাথায় পাকিস্তানি সেনারা বন্দুক কাঁধে নিয়ে অবতরণ করছে। সহসা গুড়ুম গুড়ুম শব্দ। কখনো গুড় গুড়, গুম গুম। সে শব্দের যেন আর বিরাম নেই। হঠাৎ অল্প দূরে গুলির শব্দের সঙ্গে আর্তচিৎকার। আমরা সচকিত হয়ে উঠলাম। আমাদের জঙ্গলের পাশেই পাকিস্তানি সেনারা। তারা উর্দুতে কথা বলতে বলতে আমাদের একেবারে কাছাকাছি আসতেই অতুল বাবু ভয়ে জঙ্গল থেকে বের হয়ে দৌড় দেন। 

আরও পড়ুন :- কুটির শিল্প - বাংলা প্রবন্ধ রচনা

কাফের বলেই এক পাকিস্তানি সেনা বন্দুকের ট্রিগার টানতেই গুড়ুম শব্দ হয়। অতুল বাবু চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কী বীভৎস, কী নির্মম সে দৃশ্য! ছটফট করতে করতে অতুল বাবুর জীবনলীলা শেষ হয়ে গেল। আমরা তখন জঙ্গলের ভেতর মাটির সঙ্গে মরার মতো শুয়ে আছি । কী এক দুঃসহ ভীতি আমাদের যেন অবশ করে ফেলেছে।

শেষ বেলায় পাকিস্তানি সেনারা চলে গেল। সবাই বাড়িতে ফিরে এলাম। কিন্তু কোথাও একটি ঘরের চিহ্ন নেই। গ্রামটা পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিয়ে গেছে। জলন্ত ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকিয়েই আবার ছুটে গেলাম অতুল বাবুকে দেখতে। তাঁর বুকের পাশটা ছিদ্র হয়ে গেছে ।

মনে পড়ল তার সেই কথা— কে জানে, আজ কে বাঁচবে আর কে মরবে? মৃত্যুর পূর্বক্ষণেও তিনি কি ভেবেছিলেন তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্তটি কী নির্মমভাবে তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে? হায়রে নিয়তি! এই মর্মস্পর্শী দৃশ্য কি কোনোদিন ভোলা যায়?

উপসংহার : 

সভ্যতার উৎকর্ষের যুগে মানুষ কেন এমন পাশবিক উল্লাসে মেতে ওঠে, মৃত্যু কেন এত নির্মম হয়— এ প্রশ্ন আমাকে আজও অহরহ দংশন করছে। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শান্ত, সরল বাঙালির মর্মান্তিক বলিদান কখনো কি ভোলা যায়?

Post a Comment

0 Comments