বাংলা প্রবন্ধ রচনা : বাংলাদেশে দুর্নীতির কারণ ও প্রতিকার

উপস্থাপনা : 

দুর্নীতি বিশ্বব্যাপী; কিন্তু অনুন্নত দেশের দুর্নীতি হচ্ছে সবচেয়ে দুর্বল শাসন ব্যবস্থার বহিঃপ্রকাশ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিরাট প্রতিবন্ধক । অনুন্নত দেশে টাকা প্রতি ৯০ পয়সা নাকি দুর্নীতিবাজরা খেয়ে ফেলে, বাকি ১০ পয়সা গরিবের ভাগ্যে জোটে । ফলে তারা ক্রমাগত দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আটকা পড়ে যায়। যে অর্থে আমলা কামলা, রাজনীতিবিদরা খেয়ে খেয়ে হজম করছে, তা কিন্তু হাড্ডিসার মানুষগুলোকেই জিম্মি করে আনতে হয় আর সেসব পরিশোধ করা কিংবা তার ওপর সুদ প্রদান তাদের রক্ত ও ঘামের শিক্ষিত সমাজ সোচ্চার হয়, 

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দেয়া হয়, মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সভা- সমিতি সিম্পোজিয়াম হয়, সংগঠিত আন্দোলন হয়; কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে তেমন কোন উচ্চবাক্য হয় না। কেননা দেশের সচেতন নাগরিক তথা শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও তথাকথিত অভিজাত শ্রেণীর অধিকাংশ দুর্নীতির ফলভোগী ও দুর্নীতিবাজদের সহযোগী ।

দরিদ্র দেশের দুর্নীতিবাজ : 

দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলোতে প্রবাদ-প্রবচন রয়েছে যে, টাকা হলে বাঘের চোখও মেলে । মৃত বাঘের চোখ পাওয়া দুষ্কর নয় । এসব দেশে আরও বলা হয়, টাকা হলে বাঘের দুধও মেলে। জনশ্রুতিতে এমন কথাই প্রচলিত আছে যে মারবি ত গণ্ডার, লুটবি তা ভান্ডার। ভান্ডার লুটার সম্পদ দিয়ে প্রতিবিধানকারীদের মুখ বন্ধ করেও নিজের চৌদ্দ পুরুষের আখের গুছিয়ে নেয়া যায় অথচ মজার কথা হলো। 

এসব দেশের দুর্নীতি দমন ব্যুরোই হচ্ছে সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ আর পুলিশ ও বিচার বিভাগ নাকি সেয়ানে সেয়ানে মাসতুতো ভাই । এখন দুর্নীতিবাজ ধরতে পুলিশ তলব করতে হয়, পুলিশকে ধরতে কাকে তলব করা হবে? এক্ষেত্রে এদেশের ঈমানদার মুসলিম সমাজের একমাত্র ভরসা হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা, বেহেশত আর পরলোক । তারপরও আল্লাহ্ রাসূল, মসজিদ- মক্তব, কুরআন-হাদীসকেও দুর্নীতির ক্ষেত্রে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। 

আরও পড়ুন :-  বাংলাদেশে দুর্নীতির কারণ ও প্রতিকার 

সবচে' দুর্নীতিবাজরা জীবনের এক পর্যায়ে এসে ধর্মপথে এতটা মেতে ওঠে যে, কোন মানুষের ধারণা হতে পারে, প্রথম জীবনে আকণ্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে পরবর্তীতে জনহিতকর কাজে আত্মনিয়োগ করলে আল্লাহ্ সব গুনাহ মাফ করে দেবেন। সব প্রজন্মের কাছে বক ধার্মিকদের এসব আচরণ বরং নজীর ও উদ্দীপনা হিসেবে তুলে ধরা যায় । অনেককে বলতে শুনেছি, আগে কামাও, পরে কমাও। আগে স্তুপ কর, তারপর কেটে কেটে খাট কর ।

দুর্নীতি এদেশ-বিদেশে : 

দুর্নীতি সবচে বেশি কুঁড়ে খায় গরিব মানুষকে; অথচ আমাদের মতো দেশে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে গরিব মানুষেরও কোন ঘেন্না, প্রতিরোধ কিংবা প্রতিবাদ নেই । দারিদ্র্যকে তারা বিধিলিপি বলে মেনে নিয়েছে, ধনবানদের তারা ত্রাতারূপে মূল্যায়ন করে। দুর্নীতিবাজদের প্রতিষ্ঠিত মসজিদে নামায পড়তে কিংবা তাদের দেয়া যাকাত হাত পেতে নিতে একটুও দ্বিধাবোধ করে না। এদেশের তথাকথিত কমিউনিষ্টরাও দুর্নীতিবাজ। 

তরা পুঁজিবাদের নিকুচি করে কিংবা পুঁজিবাদীকে দুর্বল করতে নাকি দু'হাতে ঘুষ খায় । তাই বলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষ ও ধর্মানুসারীরা সব ফেরেশতা, সে কথা বলা ঠিক হবে না। শোনা যায়, হিতরো বিমানবন্দর থেকে বিমানে বসেই একজন ব্রিটিশ তার আসল রূপ আবিষ্কার করে। আফ্রিকা, এশিয়া বা ল্যাটিন আমেরিকার মাটিতে পা রেখে তারা আদিম মানব প্রকৃতি নিজের মাঝে খুঁজে পায় । 

যাদের পেটেই ইংরেজি, ফরাসি ও স্পেনিশ ভাষা পড়েছে, তারাই দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে গেছে।ব্যতিক্রম আছে, তবে তার কারণ সামাজিক বা ধর্মীয় মূল্যবোধ নয়, দেশাত্মবোধও নয়, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত ব্যবস্থা। একজন ব্রিটিশ ঘুষ খেয়ে টাকা কী করবে? তার সম্পদ বেড়ে তার জীবনযাত্রায় ত্বরিত পরিবর্তন ঘটলে তা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আসবেই। কর কর্তৃপক্ষও ঘুষ খেয়ে তা হজম করতে পারবে না। তাই সে ঘুষ গ্রহণও করতে পারবে না । 

আরও পড়ুন :-  অপসংস্কৃতি ও তরুণ সমাজ : রচনা [ ক্লাস ৬, ৭, ৮, ৯, ১০ ]

সমাজটা এমন যে, তাতে দুর্নীতি পরিব্যপ্ত হলে দুর্নীতিবাজদের মুখে থুতু পড়বে। আমাদের এখানটায় দুর্নীতিবাজদের প্রতি গেন্না নেই কিংবা দুর্নীতিবাজদের সম্পদ জব্দ করার ব্যবস্থাও নেই, দুর্নীতিবাজদের হাতে জীবনকাঠিটা নাড়ানোর কারণে দিন দিন দুর্নীতি প্রসারিত হচ্ছে। অনুন্নত দেশে দুর্নীতি প্রসারের আরও বহু কারণ রয়েছে।

দুর্নীতির কারণ : 

ইসলামের বিধান, ঘুষ প্রদান ও গ্রহণকারী উভয়ই জাহান্নামী। 'ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর' সতর্কতার মতো উপরিউক্ত ধর্মীয় বিধান অন্তত ঘুষ প্রদান ও গ্রহণকারীকে বিচলিত করে না। উভয়পক্ষ দুর্নীতি দ্বারা উপকৃত হয় বলে দুর্নীতি সামাজিক রীতি হিসেবে নিন্দিত না হয়ে বরং সসম্মানে গ্রহণযোগ্য হয়ে গেছে। ঘুষ এখন আর ঘুষ নয়, বখশিশ বা হাদিয়া হিসেবে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। আমলাদের কাজে সম্মত করাতেও তাতে গতি সঞ্চার করাতে প্রণোদনা হিসেবেও ঘুষকে ব্যবহার করা হয় । ব্যক্তি উদ্যোক্তারা

ঘুষের মাধ্যমে পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, টেলিফোন ব্যয় কমিয়ে আনে। তাতে মুনাফা বাড়ে, কম দামে জিনিস বিক্রি করতে পারে, কর পরিহার করতে পারে এবং প্রতিপক্ষের ওপর টেক্কা মারতে পারে। ঘুষ দিয়ে লাইসেন্স-পারমিট ইত্যাদি পাওয়া যায়, ঘুষ দিয়ে বাজারে প্রতিপক্ষের প্রবেশকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং বাজারে এক ধরনের মনোপলি ও অলিগোপলি অবস্থা সৃষ্টি করে রাতারাতি ক্রেতার দুর্গতিকে উপজীব্য করে ধনী হওয়া যায় ৷ 

ঘুষ খেয়ে পিয়ন-চাপরাশি থেকে শুরু করে কর্তাব্যক্তিরা চৌদ্দ পুরুষের জন্য নিশ্চিত জীবনের গ্যারান্টি পেয়ে যায়, ছেলেমেয়েকে বিদেশে পড়াতে পারে, রাজনীতিতে জড়াতে পারে, ভোট কিনে নির্বাচিত হয়ে আরও অর্থবিত্ত প্রতিপত্ত অর্জনের পথ সুগম করে নেয় । ছেলেমেয়েরা ভালো শিক্ষার কারণে ভালো চাকরি, ব্যবসায় এমনকি ভালো স্বামী কিংবা স্ত্রী পেয়ে যায়। ঘুষের অর্থে মাস্তান পোষা যায়, মাস্তান দিয়ে বিচার কার্যকে বিঘ্নিত করা যায়, 

পুলিশের রিপোর্ট বদলিয়ে দেয়া যায়, যার ফলে মনে হবে অর্থবিত্ত, সম্পদই হচ্ছে মানুষের জীবনের পরম আরাধ্য এবং সেগুলো দ্রুত আহরণের নিশ্চিত ও অনেকটা নির্বিঘ্ন উপায় হচ্ছে দুর্নীতি। স্পষ্ট দেখা যায়, ঘুষ হচ্ছে দুর্নীতির একটি বিশেষ রূপ । সমাজ কতিপয় জিনিসকে সহনীয় পর্যায়ে রাখতে এগুলোকে দুর্নীতি বলে না কিংবা কোন কোন ঘুষকে বরং ফি হিসেবে হালাল বা জায়েজ করে নেয় ।

আরও পড়ুন :-  বাংলা প্রবন্ধ রচনা - সন্ত্রাস

দুর্নীতির প্রতিকার : 

দুর্নীতি উচ্ছেদের জন্য সমাজতন্ত্রীদের প্রেসক্রিপশন হচ্ছে ব্যক্তি সম্পদ বিলোপ। বিশ্বে আপাতত এটা অকৃতকার্য প্রমাণিত হয়েছে। দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে সকল মানুষকে ধার্মিক বানিয়ে ফেলা। তবে তা শুধু তাত্ত্বিক পর্যায়েই থেকে যাচ্ছে । দুর্নীতি দমনের তৃতীয় উপায় হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠান, পলিসি, পদ্ধতি ও কর্মপন্থার সংস্কার। এ সংস্কারের অংশ হিসেবে আর্থিক ব্যবস্থায় মুক্ত বাজার প্রবর্তনে এক ধরনের উন্মাদনা এখন দেখা যাচ্ছে । 

অতএব, সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ পরিধি হ্রাস, আইনের বিশ্বাসযোগ্য প্রয়োগ, গণশাসনের আমূল সংস্কার, গণপ্রতিনিধিদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রদান, গণসচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে পারে। দুঃখের বিষয় এ গনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য যারা আত্মনিয়োগ করতে পারেন, তারাও কমবেশি দুর্নীতিবাজ । মাফিয়াচক্র দ্বারা তারা উপদ্রুত হতে পারে। সেক্ষেত্রে জীবনের মায়ায় অনেক সজ্জনও দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলে না ।

উপসংহার : 

সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ দুর্নীতিপ্রবণ দেশ হিসেবে বারবারই উঠে আসছে। সংবাদ শিরোনামে দুর্নীতির বিস্তার আজ তৃণমূল পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত। এমন একটা সময়ে আমরা এসে পৌঁছেছি যে, এখন দুর্নীতিই হচ্ছে আমাদের নীতি স্বজনপ্রীতিই এখন স্বদেশ ও স্বজাতিপ্রীতি। দুর্নীতিকে নির্মূল করতে হলে শুধু পাঠ্যপুস্তকে ন্যায়নীতির কথা লিপিবদ্ধ থাকলেই চলবে না । কেননা যে ছাত্রটি ন্যায়নীতির কথা পড়তে পড়তে বড় হলো, 

সে যদি কর্মক্ষেত্রে তার প্রয়োগ দেখতে না পায়, তবে তার হতাশাগ্রস্ত চৈতন্য তাকেও একই পথে পরিচালিত করবে। তাই পুরো সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ঢেলে সাজাতে হবে । ন্যায়নিষ্ঠ ও নীতিবিদ লোকদেরকে কাজ করার সুযোগ ও সুবিধা দিতে হবে। যদিও একটি দেশের সামগ্রিক কাঠামোকে ঢেলে সাজানো সহজ কথা নয়, তবুও সরকার ও জনসাধারণের আন্তরিক সহযোগিতায় সবকিছুই সম্ভব।

Post a Comment

0 Comments