ভাষণ বা বক্তৃতা একটি শিল্প। এটি বাচনিক শিল্প হিসেবেই স্বীকৃত। প্রায় প্রত্যেক মানুষকেই জীবনের কোথাও না কোথাও ভাষণ দিতে হয়; হয় সেটা আনুষ্ঠানিক কিংবা অনানুষ্ঠানিক। সহজ ও সুন্দর ভাষায়, সাবলীল ভঙ্গিতে ভাষণ দেয়াকেই আর্ট বা শিল্প বলা হয়। বিষয়টি সহজ নয়। প্রশিক্ষণ বা অনুশীলনের মাধ্যমে এ সুকুমার বৃত্তিটি আয়ত্ত করা সম্ভব ।
ভাষণের সংজ্ঞা :
কোনো নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে নিয়মসিদ্ধভাবে আনুষ্ঠানিক বক্তৃতাকে ভাষণ বলে। অর্থাৎ কোনো বিষয়বস্তু সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ বক্তব্য প্রদানকেই ভাষণ বলে।
বস্তুতপক্ষে ভাষণ একটি বাচনিক শিল্পমাধ্যম। কারণ সহজ, সরল ও সুন্দর ভাষায় সাবলীল বক্তব্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়েই বাচনিক শিল্পবোধের প্রকাশ ঘটে। নিয়মিত অনুশীলন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানুষের এ সুকুমার বৃত্তি আয়ত্ত করতে হয়। হঠাৎ করে বা একদিনেই সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে ভাষণ বা বক্তৃতা দেয়া কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয় না। তাই এক্ষেত্রে নিয়মিত অনুশীলন অপরিহার্য।
ভাষণের শ্রেণিবিভাগ :
ভাষণ প্রধানত তিন প্রকার। যথা-
১। মঞ্চ ভাষণ।
২। বেতার ভাষণ।
৩। টেলিভিশন ভাষণ।
এছাড়া পথ ভাষণ, উপস্থিত ভাষণ, ধর্মীয় ভাষণ উল্লেখযোগ্য।
আরও পড়ুন : সমাস কাকে বলে?সমাসের অংশ কয়টি ও সমাসের প্রয়োজনীয়তা
ভাষণের বিবেচ্য বিষয়সমূহ :
ভাষণের বিবেচ্য বিষয়সমূহ নিম্নরূপ—
১. ভাষণের ভাষা সহজ, সাবলীল ও প্রাঞ্জল হওয়া আবশ্যক ।
২. ভাষণের জন্য সময় নির্দিষ্ট থাকলে যথাসময়ে ভাষণ শেষ করা আবশ্যক।
৩. মঞ্চ ও টেলিভিশনের ক্ষেত্রে বক্তার মুখ ও অঙ্গভঙ্গি শ্রোতারা দেখতে পায়। সেক্ষেত্রে বক্তার অঙ্গভঙ্গি, উপস্থাপনভঙ্গি শ্রোতারা প্রত্যক্ষ করে বলেই মার্জিত অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে বক্তব্য পেশ করতে হবে।
৪. বেতার ভাষণের ক্ষেত্রে বক্তার মুখ ও অঙ্গভঙ্গি শ্রোতারা দেখতে পায় না। ফলে বক্তার বাচনভঙ্গি আকর্ষণীয় ও বক্তব্য বিষয় সুস্পষ্ট হওয়া আবশ্যক ।
৫. বক্তার বক্তব্য বিষয়ের শুরু ও শেষ আকর্ষণীয় হতে হবে।
৬, বিষয়বস্তুকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে প্রতিটি অংশের সামঞ্জস্য রক্ষা করে বক্তব্য তুলে ধরতে হবে।
৭. বক্তব্যে প্রতিষ্ঠিত সত্য ও তথ্য দৃঢ়কণ্ঠে প্রকাশ করতে হবে।
৮. বক্তব্যে বক্তার নিজস্ব মতামত প্রকাশ করতে হবে।
৯. বক্তার মনের প্রতিক্রিয়া ও ব্যক্তিত্ব পরিস্ফুটিত হতে হবে।
ভাষণের লক্ষণীয় বিষয় :
ভাষণের লক্ষণীয় বিষয়গুলো নিম্নরূপ-
১. ভাষা হবে বোধগম্য ।
২. শ্রোতা ভাষণটি শুনে বিষয়টি সম্পর্কে যেন স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারে।
৩. ভাষণের শেষ হতে হবে নাটকীয়, যাতে শ্রোতাদের আকর্ষণ করতে পারে।
৪. মনে রাখতে হবে যে, বক্তব্যে প্রতিষ্ঠিত সত্য ও মিথ্যার সংমিশ্রণ যাতে না ঘটে।
৫. নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভাষণ শেষ করতে হবে ।
আরও পড়ুন : সমাস নির্ণয়ের উপায়। সন্ধি ও সমাসের মধ্যে পার্থক্য - PDF
ভাষণের একান্ত দিকগুলো :
ভাষণের একান্ত দিকগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো—
১. মঞ্চ ভাষণে সভাপতি থাকলে- মাননীয় সভাপতি, প্রধান অতিথি থাকলে— সম্মানিত প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি থাকলে- সম্মানিত বিশেষ অতিথি, অন্যান্য অতিথিকে উপস্থিত সম্মানিত অতিথিবৃন্দ এবং শ্রোতৃবর্গকে সম্বোধন করে বক্তৃতা আরম্ভ করতে হবে। তবে সভাপতি নিজে বক্তৃতা প্রদানকালে মাননীয় সভাপতি বলার দরকার নেই। এক্ষেত্রে শুধু অতিথি এবং শ্রোতৃমণ্ডলীকে সম্বোধন করলেই চলবে। বক্তব্য শেষে সমাপ্তিসূচক আল্লাহ হাফেজ, খোদা হাফেয বা ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করা শ্রেয়।
২. বেতার ভাষণে এরূপ সম্বোধনের প্রয়োজন নেই। তবে সম্মানসূচক আল্লাহ হাফেয, খোদা হাফেয, বা ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করা বাঞ্ছনীয়।
৩. টেলিভিশন ভাষণে সম্বোধনের প্রয়োজন খুব একটা পড়ে না। তবে কখনো কখনো সভাপতি, অতিথি কিংবা শ্রোতৃমণ্ডলীর উপস্থিতিতেও ভাষণ বা বক্তৃতা চলে। যেমন— বিতর্ক প্রতিযোগিতা। এক্ষেত্রে অবশ্যই উপযুক্ত সম্বোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় । বিশেষ বিশেষ কারণে কিংবা উপলক্ষে রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বা জননেতার ভাষণ টিভিতে প্রচারিত হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে প্রিয় দেশবাসী, সংগ্রামী জনতা ইত্যাদি সম্বোধনের মাধ্যমে বক্তৃতা শুরু করে বক্তব্যের বিষয় উপস্থাপন করতে হয়।
ভাষণের উপকারিতা :
ভাষণের উপকারিতা নিচে প্রদত্ত হলো-
১. প্রকাশ্যে জনতার মাঝে দাঁড়িয়ে কোনো বিষয়ে ভাষণ দেয়ার মাধ্যমে বক্তার আত্মপ্রত্যয় বৃদ্ধি পায়।
২. মানুষের মাঝে নিঃসংকোচে কথা বলার কৌশল ও অভিজ্ঞতা সঞ্চারিত হয়।
৩. ভাষণের মাধ্যমে কোনো বিস্তৃত বিষয়কে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শ্রোতার কাছে উপস্থাপনের কারণে সময় সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় ।
৪. কোনো বিবেচ্য বিষয় বা ঘটনার বিশ্লেষণ ক্ষমতার বিকাশ সাধিত হয় ভাষণের মাধ্যমে।
আরও পড়ুন : ভাষার দক্ষতা কয়টি ও কি কি এবং ভাষা ও ব্যাকরণের মধ্যে পার্থক্য
সাধারণ দিক :
ভাষণের সাধারণ দিকগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো-
ক. সম্ভাষণ : যে কোনো বক্তৃতায় সম্ভাষণ অতি গুরুত্বপূর্ণ। এ অংশের আকর্ষণীয়তার দ্বারা মূল বক্তব্যের প্রতি শ্রোতৃবর্গের দৃষ্টি ও মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়। এদিকে বিশেষ খেয়াল রাখা দরকার ।
খ. সূচনা : বক্তৃতার দ্বিতীয় অংশ হলো বক্তৃতার সূচনা। উল্লেখ্য, এ অংশের চমৎকারিত্বের ওপর মূল বক্তৃতার সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে। ধরা যাক, উপলক্ষটি ১৬ ডিসেম্বর। বক্তৃতার সূচনা করা যেতে পারে এভাবে- আজ ১৬ ডিসেম্বর। এভাবে সূচনাটি সবসময় অনুষ্ঠান বা উপলক্ষের অনুসারী হবে।
গ. মূল বক্তব্য : এটি বক্তৃতার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এক্ষেত্রে কোনো মনীষীর বাণী, সাম্প্রতিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা, সংবাদপত্রের উদ্ধৃতি ব্যবহার করে এ অংশটিকে সমৃদ্ধ করা যেতে পারে। তাছাড়া এর কোথাও কোথাও বক্তব্য হবে ভাবগম্ভীর, কোথাও হবে তির্যক, পরিহাসমূলক, চটুল। কোথাও হবে প্রশ্নাতুর। নইলে বক্তৃতাটি শ্রোতাদের কাছে একঘেয়েমি লাগতে পারে।
১. আকর্ষণীয় চেহারা ।
৩. উদাত্ত কণ্ঠস্বর ।
৫. উপযুক্ত যতির ব্যবহার ।২. উপযোগী পোশাক-পরিচ্ছদ ।
৪. সুস্পষ্ট উচ্চারণ ।৬. মুদ্রাদোষ পরিহার ।