ছত্রাক হলো ক্লোরোফিলবিহীন পরভোজী সমাঙ্গদেহি এক প্রকার নিম্নশ্রেণীর বৈচিত্রময় উদ্ভিদ।
ছত্রাকের গুরুত্ব (Importance of Fungi)
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ছত্রাক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। মনুষ্য খাদ্য, ঔষধ, শিল্পজাত দ্রব্য, মাটি গঠন, কৃষিকাজ, গবেষণা উপকরণ, স্বাস্থ্যবিধান ইত্যাদি ক্ষেত্রে ছত্রাকের যেমন উপকারী ভূমিকা রয়েছে তেমনি বিপরীতক্রমে পরজীবিতা ও রোগ সৃষ্টিকারী অপকারী ভূমিকাও রয়েছে। ছত্রাকের উপকারী এবং অপকারী উভয় ভূমিকাই অর্থনৈতিক গুরুত্বের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলে । নিম্নে ছত্রাকের অর্থনৈতিক গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :
ছত্রাকের উপকারিতা :-
মানবজাতির খাদ্য হিসেবে ছত্রাক :
সমগ্র বিশ্বে প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি ছত্রাক মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়। মুখরোচক, প্রোটিন, শর্করা ও ভিটামিন সমৃদ্ধ Agaricus campestris এবং Podaxon podaxis নামক মাশরুম, Lycoperdon, Clavatia নামক পাফবল (puffball)। এছাড়াও কতিপয় ছত্রাকের টিউবার ইত্যাদি খাদ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য ।
খাদ্য শিল্পে ব্যবহার :
পনির শিল্পে পনিরের স্বাদ, গন্ধ ও আকর্ষণী বর্ণ সৃষ্টির জন্য ছত্রাকের ব্যবহার রয়েছে। যেমন— সবুজ পনির প্রস্তুতিতে Penicilliums cascicolum এবং নীল পনির প্রস্তুতিতে Proqueforti ব্যবহার হয় ।
ভিটামিন প্রস্তুতিতে :
ঈস্ট বা Saccharomyces হলো ভিটামিন বি-কমপ্লেক্সের একটি ভালো উৎস। এছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণির ছত্রাক থেকে ভিটামিন-B, ভিটামিন-D, ভিটামিন-C, রাইবোফ্লেভিন ইত্যাদি প্রস্তুত করা যায় ।
আরও পড়ুন :- ছত্রাক কি? কাকে বলে। ছত্রাকের বৈশিষ্ট্য, গঠন এবং শ্রেণীবিন্যাস
ঔষধ শিল্পে ছত্রাকের অবদান :
১৯২৯ সালে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং কর্তৃক আবিষ্কৃত পেনিসিলিন হলো পৃথিবীর প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক। অ্যান্টিবায়োটিক হলো ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাকজনিত রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ের জন্য জীবাণু প্রতিরোধী ছত্রাকজাত ঔষধ ।
চর্মরোগ প্রতিরোধ :
Penicillium griseofulvum নামক ছত্রাক থেকে উৎপন্ন অ্যান্টিবায়োটিক গ্রাইসোফুলভিন ছত্রাকজনিত চর্মরোগ নিরাময়ের জন্য শক্তিশালী ঔষধ।
ক্যান্সার ও টিউমার নিরাময়কারী :
Clavatia নামক ছত্রাকে ক্যান্সার নিরোধক গুণ এবং উক্ত ছত্রাক হতে প্রাপ্ত অ্যালকালয়েড Clavacin পাকস্থলীর টিউমার নিরাময়ে কার্যকরী।
শিল্পক্ষেত্রে :
ছত্রাক হতে ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়ায় ইথাইল অ্যালকোহল (C2H5OH) প্রস্তুত করা হয়। এটি মাদকদ্রব্য হিসেবে পরিচিত। অ্যালকোহল উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রধানত ঈস্ট নামক ছত্রাকটিই ব্যবহার হয়।এছাড়া উন্নত মানের মদ প্রস্তুতিতে Mucor, Rhizopus ও Aspergillus নামক ছত্রাকও ব্যবহার হয়।
পাউরুটি, কেক, বিস্কুট ইত্যাদি ফোলানোর জন্য ময়দার সাথে ঈস্ট পাউডার মিশ্রিত করতে হয়। অর্থাৎ পাউরুটি শিল্প তথা বেকারি শিল্পে ছত্রাকের বহুল ব্যবহার রয়েছে।
বিভিন্ন প্রকার এনজাইম বা উৎসেচক উৎপাদনে ছত্রাক ব্যবহার হয়। যেমন- Aspergillus oryzae, A. niger হতে অ্যামাইলেজ, পেকটিনেজ, প্রোটিয়েজ ইত্যাদি Saccharomyces cerevisiae হতে ইনভারটেজ ইত্যাদি উৎসেচক পাওয়া যায় ।
আরও পড়ুন :- আলুর লেট ব্লাইট রোগ এবং দাদ রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার
* জৈব এসিড উৎপাদনে :
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কতিপয় জৈব এসিড, যেমন– অক্সালিক এসিড, সাইট্রিক এসিড, গ্লুকোনিক এসিড, গ্যালিক এসিড, ফিউমারিক এসিড, ল্যাকটিক এসিড ইত্যাদি উৎপাদনের জন্য Aspergillus ও Rhizopus নামক ছত্রাকের কয়েকটি প্রজাতি ব্যবহার হয় ।
হরমোন উৎপাদনে :
উদ্ভিদের বৃদ্ধি সাধন, বৃদ্ধির হারের তারতম্য পরীক্ষার জন্য জিব্বারেলীন নামক হরমোন ব্যবহার হয় যা Gibberella fujikuroi নামক ছত্রাক হতে নিষ্কাশিত হয় ।
রঞ্জক পদার্থ উৎপাদনে :
কয়েকটি রঞ্জক পদার্থ ছত্রাক থেকে নিষ্কাশন করা হয়, যা শিল্পে বহুল ব্যবহার হয়। যেমন- পেনিসিলিন হতে হরিদ্রা বর্ণের সাইট্রিসিন, Helminthosporium হতে লোহিত বর্ণের ক্যাটেনারিন, Aspergillus হতে তামাটে বর্ণের ফুমিগেশন ইত্যাদি
কৃষিক্ষেত্রে :
বিভিন্ন মৃতজীবী ছত্রাক, যেমন— Mucor, Rhizopus, Ascobolus ইত্যাদি কৃষিজাত অব্যবহার্য জৈব দ্রব্য, মৃত জীবজন্তুর দেহ পচিয়ে মাটিতে মিশ্রিত করার ফলে মাটিতে সারের স্বল্পতা পূরণ হয়।
'হিউমাস গঠনের মাধ্যমে ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। পাশাপাশি মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
রোগসৃষ্টিকারী ও শস্য ধ্বংসকারী ক্ষতিকারক জীবাণু ও কীটপতঙ্গের দেহে বিভিন্ন ছত্রাক পরজীবীরূপে বসবাস করে জীবাণু ও কীটপতঙ্গ ধ্বংস করে জৈবিক নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
বিজ্ঞান গবেষণায় ছত্রাকের বহুবিধ ও গুরুত্বপূর্ণ, ব্যবহার রয়েছে। ছত্রাকের জীবনচক্র অল্প পরিসরে অতিদ্রুত ও অল্প সময়ে সম্পন্ন হয় বলে কোষবিদ্যা, বংশগতিবিদ্যা, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদির বহুবিধ গবেষণায় গবেষণা উপকরণ হিসেবে Neurospora crassa, Saccharomyces, Physarum ইত্যাদি ছত্রাক ব্যবহার হয়।
আরও পড়ুন :- লাইকেন কাকে বলে? লাইকেনের বৈশিষ্ট্য এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব
ছত্রাকের অপকারিতা:-
(i) উদ্ভিদদেহে রোগ সৃষ্টি :
উদ্ভিদ সম্প্রদায়ে যেসব রোগ হয় তার সিংহভাগই ছত্রাকজনিত। ছত্রাকঘটিত এসব রোগের কারণে প্রতিবছর শস্য, শাকসবজি, ফলমূল, কাষ্ঠ উৎপাদনকারী মূল্যবান উদ্ভিদের অপুরণীয় ক্ষতিসাধন হয়। নিম্নে কয়েকটি উদ্ভিদের রোগ সৃষ্টিকারী ছত্রাক, পোষক উদ্ভিদ ও রোগের নাম দেওয়া হলো—
ছত্রাক | পোষক | রোগ |
---|---|---|
Drechslera oryzae | ধান | বাদামি দাগ রোগ |
Phytophthora infestans | আলু | বিলম্বিত ধসা রোগ |
Macrophomina phaseolina | পাট | কাণ্ড পচা রোগ |
Colletotrichum falcatum | আখ | লোহিত পচন রোগ |
Puccinia graminis tritici | গম | কালো মরিচা রোগ |
(ii) মানবদেহে ও প্রাণিদেহে রোগ সৃষ্টি :
মানুষ, গৃহপালিত প্রাণী ও অন্যান্য প্রাণিদেহে ছত্রাক নানা প্রকারের রোগ সৃষ্টি করে থাকে ।
ছত্রাক | রোগ |
---|---|
Candida ablicans | মানুষের ক্যানডিডিয়াসিস নামক চর্মরোগ সৃষ্টি করে । |
Microsporum | চুলের গোড়া ক্ষয় হয়ে চুল উঠে যায় এবং মাথায় টাক পড়ে। |
Trichophyton | দাদ নামক কষ্টদায়ক চর্মরোগ হয়। |
Absidia corymbifera | মানুষসহ গৃহপালিত পশুর ব্রঙ্কোমাইকোসিস নামক শ্বাসনালির রোগ সৃষ্টি করে। |
Aspergillus niger | মানুষ ও অন্যান্য প্রাণিদেহে অ্যাসপারজিলোসিস নামক রোগ সৃষ্টি করে। |
Saprolegnia parasitica | মাছ ও মাছের ডিমসহ অন্যান্য প্রাণীকে আক্রমণ করে এবং মৃত্যু ঘটায় । |
Polyporus নামক ছত্রাক কাঠের গুঁড়িতে জন্মে কাঠের গুণগত মান বিনষ্ট করে। এছাড়া Penicillium divaricatum, Fusarium regundi, Alternaria, Trichoderma, Ceratocystis ইত্যাদি নামক ছত্রাক কাঠ ও কাঠের আসবাবপত্রে বিভিন্ন বর্ণের দাগ সৃষ্টি করে আসবাবপত্রের সৌন্দর্য নষ্ট করে।
বই-খাতা, দলিল-দস্তাবেজ, চিত্রকর্ম, দেয়ালের ক্যালেন্ডার ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ধ্বংস হয়।
সুতিবস্ত্র, লিনেন, তুলা, পাট দিয়ে তৈরি সুতার সম্পূর্ণ অংশই সেলুলোজ, ছত্রাক বিশেষ ধরনের এনজাইম নিঃসৃত করে সেলুলোজ বিনষ্ট করে। এছাড়া ভেজা কাপড়-চোপড়ের উপর কালো বিন্দুর মতো - 'চিতি' সৃষ্টি করে।
কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্র, ধাতব চিত্রকর্ম প্রভৃতির উপর সবুজাভ দাগ সৃষ্টি করে Penicillium-এর কতিপয় প্রজাতি। Aspergillus ও Penicillium নামক ছত্রাক কাচ ও কাজাত সামগ্রী, যেমন— চশমা, ক্যামেরা, বাইনোকুলার, অণুবীক্ষণ যন্ত্র প্রভৃতির লেন্সের উপর জন্মে লেন্সকে ঘোলা করে ফেলে। এছাড়া চামড়াজাত দ্রব্যাদিও ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হয়।
(iv) খাদ্যদ্রব্য বিনষ্টকরণ :
বিভিন্ন প্রকার ছত্রাকের আক্রমণে শুধু যে খাদ্যের গুণগত মান নষ্ট হয় তাই নয়, উপরন্তু খাদ্যকে পচিয়ে বিষাক্ত করে তোলে। Mucor, Rhizopus, Penicillium, Phytophthora-সহ আরও কতিপয় ছত্রাকের আক্রমণে বিভিন্ন ফলমূল, শাকসবজি, দুধ ও প্রোটিনজাত দ্রব্য, মাছ, মাংস তরিতরকারি ইত্যাদি বিনষ্ট হয়।