ইসলামে ভ্রাতৃত্ববোধ অথবা, ইসলামী ভ্রাতৃত্ব - রচনা

 উপস্থাপনা :

"আরব আমার ভারত আমার 

চীনও আমার, নহে গো পর

বিশ্বজোড়া মুসলিম আমি

সারাটি জাহানে বেঁধেছি ঘর।"

আদম সন্তান একে অপরের ভাই। ইসলামের দৃষ্টিতে সবাই সমান। ইসলামের দৃষ্টিতে আভিজাত্যের গর্ব, উঁচু-নীচু, সাদা-কালো, ধনী-দরিদ্রের কোন ভেদাভেদ নেই । মুসলমানদের পারস্পরিক প্রেম-ভালবাসা তথা প্রীতির সম্পর্ককেই আল্লাহ তায়ালা তার শ্রেষ্ঠতম নিয়ামতের মধ্যে গণ্য করেছেন।

ইসলামে ভ্রাতৃত্ববোধের ধারণা 

ইসলামে ভ্রাতৃত্ববোধ বা ভ্রাতৃত্ব বন্ধন বুঝাবার জন্য আরবি 'ইখওয়াত' শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ শব্দটি 'ইখওয়াতুন' মূল থেকে উৎপন্ন। ইসলামের পরিভাষায়, মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা সুখ-দুঃখের সমভাগী হওয়াকে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন বা ইখওয়াত বলা হয় । ইসলাম ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্ককে মোটামুটিভাবে দু'টি ভিত্তির ওপর স্থাপ করেছে। 

একটি হচ্ছে- পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক। এ সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে অত্যন্ত দৃঢ় ও অবিচ্ছিন্ন বন্ধনের কাজ করে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে- অধিকার ও মান-মর্যাদা সংরক্ষণ। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- 'হে মানব জাতি! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী হতে সৃষ্টি করেছি এবং বিভিন্ন গোত্রে ভাগ করেছি। যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার'। (হুজুরাত-৩৩)।

আরও পড়ুন :- ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান - রচনা  [ ক্লাস ৬, ৭, ৮, ৯, ১০]

বস্তুতঃ এ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানব জাতিকে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধের প্রেক্ষিতে বংশ, বর্ণ, ভাষা ও দেশ ইত্যাদি সংকীর্ণ জাতীয়তাবোধে গড়ে ওঠা জাহেলিয়াতের আবর্ত থেকে বেঁচে থাকার দিকে ইঙ্গিত করেছেন।

বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে মহানবী (স) বিশ্ববাসীর কাছে যে ঘোষণা দিয়ে গেছেন, তা কবির ভাষায় এভাবে ফুটে ওঠেছে-

‘শুধু আনসার মুহাজিরীনের নহে আজি সমাবেশ

মহামানবের মহাআহ্বানে মিলেছে সকল দেশ

চরণে দলিনু অন্ধযুগের বংশ অহংকার

ভাই ভাই মিলি মুসলিম হত এক মহাপরিবার

নাই ভেদাভেদ আজমী আরবি সবি-এক আদমের সন্তান

ধূলায় রচিত আদম তনয় গর্ব কিসের তার?'

মহানবী (স)-এর ভাষণে বিশ্বমানবের জন্য ভ্রাতৃত্বের এক সুস্পষ্ট রূপরেখা ফুটে ওঠেছে । মানব জাতির ইতিহাসে এর কোন তুলনা নেই।

পবিত্র কুরআনের সূরা হুজুরাতের দশম আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেন, “মুমিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই; অতএব তোমাদের ভাইদের পারস্পরিক সম্পর্ক যথাযথভাবে সঠিক করে নাও । আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আশা করা যায় যে, তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হবে।

এ আয়াতে আল্লাহ মুসলমানদের পরস্পর ভাই বলে আখ্যায়িত করেছেন। এতে মানবীয় ভ্রাতৃত্বের সাথে দ্বীনি ভ্রাতৃত্বও বর্তমান। দু'টো একসাথে একত্রিত ও সমন্বিত । এ ভ্রাতৃত্বের দাবি হচ্ছে, তারা পরস্পর নিঃসম্পর্ক বা অপরিচিত হয়ে থাকবে না। পরস্পরের মধ্যে গভীর একাত্মতা থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয় । 

আরও পড়ুন :-  নামাজের শিক্ষা অথবা, সমাজ সংস্কারে নামাজের ভূমিকা - রচনা 

পরস্পরে কোন শত্রুতা, হিংসা-বিদ্বেষ নয়; বরং অকৃত্রিম ভালবাসা ও দয়া-সহানুভূতিই বজায় রাখতে হবে । মহানবী (স) বলেন, 'তোমরা পরস্পরে হিংসা-বিদ্বেষে লিপ্ত হবে না, কেউ কারোর পেছনে পড়ে যাবে না, কেউ কারোর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। পারস্পরিক ক্রোধ ও অসন্তোষের প্রশ্রয় দেবে না; বরং পরস্পর আল্লাহর বান্দাহ ও ভাই ভাই হয়ে থাকবে । 

হযরত আবূ সাঈদ খুদরী ও হযরত আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, মহানবী (স) বলেছেন, 'মুসলমানরা ভাই ভাই। সে তার ওপর জুলুম করবে না, তার সঙ্গ ত্যাগ করবে না, তাকে লাঞ্ছিত করবে না। এক ব্যক্তির জন্য এটিই অন্যায় যে, সে তার অপর ভাইকে হীন জ্ঞান করবে। মহানবী (স) বলেন, 'মুমিন একজন অপরজনের জন্য একটি প্রাচীরের ইট স্বরূপ হয়ে থাকে। এতে একটি ইট অপরটির সাহায্যে শক্তি লাভ করে।' (বুখারী)

বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের চেতনা :

ইসলাম এসব উপদেশাবলির ভিত্তিতে এক বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়ে বিশ্বভিত্তিক ভ্রাতৃত্বের সমাজ বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়েছে। ভ্রাতৃত্বের এ মূল্যবোধ পৃথিবীর অন্য কোন ধর্ম, জীবনাদর্শ বা সমাজব্যবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায় না। সভ্যতার তথাকথিত দাবিদার ইউরোপের শ্বেতাঙ্গরা দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর যে পৈশাচিক জুলুম-নির্যাতন চালাচ্ছে তা মানব ইতিহাসের একটি কলঙ্কময় অধ্যায়। 

হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণরা নিচু বর্ণের হিন্দুদেরকে অস্পৃশ্য মনে করে। কিন্তু পূর্ণ ভ্রাতৃত্বের রূপরেখা একমাত্র ইসলামী ব্যবস্থায়ই সার্থকভাবে রয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীতে যত নিষ্ঠুর ও নৃশংস নরহত্যা ও মানবতার অবমাননা সংঘটিত হচ্ছে, ভ্রাতৃত্ববোধ তথা মানব প্রেমের অভাবই তার মূল কারণ। আল্লামা ইকবাল বলেছেন, 'প্রেম ও ভ্রাতৃত্বের আসন মানুষের হৃদয়'। তিনি

বলেছেন-

'তোমার বীণায় বাজাও ভ্রাতৃত্বের সুর,

সবায় বিলাও তোমার প্রেম সুমধুর।' 

ভ্রাতৃত্বের বন্ধনই এ শাশ্বত প্রেমের উৎস।

উভয় জাহানের কল্যাণের বাহক ঃ 

ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ আনয়ন করে। মানুষকে ভালবাসলেই আল্লাহর ভালবাসা পাওয়া যায়। আর আল্লাহর ভালবাসাই দুনিয়া এবং আখিরাতের কল্যাণ বয়ে আনে । আল্লাহর আরশের নীচেই এ ধরনের লোকদের অবস্থান।

উপসংহার : 

পরিশেষে বলা যেতে পারে, মুসলিমদের মাঝে সম্পর্ক হতে হবে ভ্রাতৃত্বের, বন্ধুত্বের নয়। কেননা, বন্ধুত্বের সম্পর্ক রশি দিন টিকে না । ভ্রাতৃত্বের অভাবে বিশ্বের মাঝে অশান্তির অগ্নিশিখা জ্বলছে। সুতরাং একটি অখণ্ড ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পৃথিবীকে গড়তে হবে নতুনভাবে, সুশৃঙ্খলভাবে। হতে হবে একে অপরের হাসি-কান্নার অংশীদার । বিদ্রোহী কবির ভাষায়-

'ইসলাম বলে, সকলের তরে মোরা সবাই,

সুখ-দুঃখ সমভাগ করে নেব সকলে ভাই।'

আপনার পছন্দ হতে পারে এমন আরও পোস্টের তালিকা

Post a Comment

0 Comments

Bottom Post Ad