(toc) Table Of Contens
উপস্থাপনা
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া জীবন থাকে অপূর্ণ । কিন্তু যে শিক্ষা বাস্তব জীবনে কাজে লাগে না, সে শিক্ষা অর্থহীন। এ ধরনের শিক্ষায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝা বাড়ে। তাই জীবনভিত্তিক শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা। আর জীবনের সাথে সম্পৃক্ত যে শিক্ষা সেটিই কর্মমুখী শিক্ষা। একমাত্র কর্মমুখী শিক্ষাই হচ্ছে আমাদের বাস্তব জীবনের জন্য সহায়ক ৷
কর্মমুখী শিক্ষা কী
কর্মমুখী শিক্ষা হচ্ছে একজন ব্যক্তিকে তার আত্মপ্রতিষ্ঠায় সহায়তা করার লক্ষ্যে বিশেষ কোনো কর্মে প্রশিক্ষিত করে তোলা । অর্থাৎ যে শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষ কোনো একটি বিষয়ে হাতে-কলমে শিক্ষা লাভ করে এবং শিক্ষা শেষে জীবিকার্জনের যোগ্যতা অর্জন করে, তাকেই কর্মমুখী শিক্ষা বলে । কর্মমুখী শিক্ষাকে কারিগরি শিক্ষাও বলা হয়ে থাকে ।
কর্মমুখী বৃত্তিমূলক শিক্ষা কী :
কর্মমুখী বৃত্তিমূলক শিক্ষা এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা যার সঙ্গে জীবন ও জীবিকার সম্পর্কটা নিবিড়। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি আমাদের এমন এক বিশেষ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে, যা একটা নির্দিষ্ট পর্যায় অতিক্রম করার পরই জীবিকার পথকে প্রশস্ত করে তুলবে। ব্যক্তি বেকারত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে দেশের বোঝা হয়ে থাকবে না। আর এটিই কর্মমুখী বৃত্তিমূলক শিক্ষা ।
কর্মমুখী শিক্ষার প্রকারভেদ
কর্মমুখী শিক্ষা যান্ত্ৰিক শিক্ষা নয়। জীবনমুখী শিক্ষার পরিমণ্ডলেই তার অবস্থান। তাই পরিপূর্ণ ও সামগ্রিক জীবনবোধের আলোকে কর্মমুখী শিক্ষা দুই ভাগে বিভক্ত। এদের মধ্যে একটি হলো- উচ্চতর কর্মমুখী শিক্ষা । এটিতে যারা বিজ্ঞান বিষয়ে পারদর্শী তারা বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ ইত্যাদি স্বাধীন পেশা গ্রহণ করতে পারে। চাকরির আশায় বসে থাকতে হয় না। আরেকটি হলো- সাধারণ কর্মমুখী শিক্ষা।
এর জন্য কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষার দরকার হয় না। প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাই যথেষ্ট। সাধারণ কর্মমুখী শিক্ষার মধ্যে পড়ে কামার, কুমার, তাঁতি, দর্জি, কলকারখানার কারিগর, মোটরগাড়ি মেরামত, ঘড়ি-রেডিও-টিভি-ফ্রিজ মেরামত, ছাপাখানা ও বাঁধাইয়ের কাজ, চামড়ার কাজ, গ্রাফিক্স আর্টস, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, নার্সারি, ধাত্রীবিদ্যা ইত্যাদি। এ শিক্ষায় প্রশিক্ষিত হলেও স্বাচ্ছন্দ্যভাবে বেঁচে থাকা যায় ।
আরও পড়ুন :- কর্মমুখী শিক্ষা বা কারিগরি শিক্ষা -রচনা [Class - 6, 7, 8 ,9 ,10]
কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা
শিক্ষাকে কেবল আত্মিক উন্নয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, সামাজিক প্রয়োজনের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান বিশ্বে কর্মের যে মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তাতে আমাদেরকেও অংশগ্রহণ করতে হবে। কৃষিকাজ, কামারের কাজ, কুমারের কাজ, ছুতোরের কাজ, চামড়ার কাজ, বাঁশ ও বেতের কাজ, প্লাস্টিকের কাজ, তাঁতের কাজ, ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি তৈরির কাজ, রেডিও-টেলিভিশন মেরামতের কাজ ছাড়াও আরও অনেক বৃত্তিমূলক কাজ রয়েছে।
এসব কাজ শারীরিক যোগ্যতা থাকার পরও যদি আমরা করতে কুণ্ঠিত হই, তাহলে আমাদের শিক্ষাই যে কেবল নিরর্থক হবে তা নয়, আমাদের দারিদ্র্য কোনো কালেই ঘুচবে না। তাই কর্মমুখী শিক্ষা বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা বা কারিগরি শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীরা যাতে এদিকে এগিয়ে আসে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাহলে দেশ জোড়া যে বেকার সমস্যা বিরাজমান, তাও অনেকাংশে কমে আসবে। দেশ এগিয়ে যাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা
যুগের সাথে সাথে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয় নি। যদিও শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য বিভিন্ন সময়ে 'স্যাডলার কমিশন', 'কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন', 'বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন’, ‘কাজী জাফর/বাতেন কমিশন' এবং 'মজিদ খানের শিক্ষানীতি' ইত্যাদি কমিশন গঠন করা হয়— কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি সাধিত হয় নি।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা আমাদেরকে শুধু ডিগ্রি দেয় কিন্তু চাকরি বা কাজ দেয় না। তাই বেকারত্বের অভিশাপ মাথায় নিয়ে হতাশাগ্রস্ত তরুণ যুবসমাজ আজ দিশেহারা। তারা আজ অন্যের হাতের ক্রীড়নক । বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত যুবসমাজ আজ অভিশপ্ত জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থা
বিশ্বের উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যায় যে, তাদের পরিকল্পিত এবং কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার বাস্তব কর্মকাণ্ড। উন্নত বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থায় কেরানি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আছে বিজ্ঞানী হওয়ার এবং কর্মের মন্ত্রে দীক্ষা নেওয়ার। ব্রিটেন, আমেরিকা, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশ উৎপাদনমুখী বা কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্যকে প্রসন্ন করেছে। বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মমুখী শিক্ষা চালু করে তারা আজ উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছে।
আরও পড়ুন :- বৃত্তিমূলক শিক্ষা : বাংলা রচনা । Sikkhagar
কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্ব
যে শিক্ষা অর্জন করে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা যায় এবং যার মাধ্যমে সহজে জীবিকা নির্বাহ করা যায় তাই হলো কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা। কর্মমুখী শিক্ষা লাভ করলে পরমুখাপেক্ষী হতে হয় না, বেকার থাকতে হয় না; বরং এ ধরনের শিক্ষা কর্মপ্রেরণা যোগায় এবং নিজের অবস্থার উন্নতির সাথে সাথে দেশ ও জনগণের সেবা করা যায়।
একথা ঠিক যে, অদক্ষ শ্রমিক ক্রমে দক্ষ হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা পেলে তারা রাষ্ট্রের এবং সমাজের অধিকতর প্রয়োজন সুসম্পন্ন করতে পারে। এ জন্যই সকল প্রকার বৃত্তি গ্রহণের জন্য উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন করা দরকার।
প্রচলিত কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা :
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষা- এ চারটি স্তরে বিভক্ত। এর সাথে কারিগরি, প্রকৌশলী, ডাক্তারি ইত্যাদি কর্মমুখী শিক্ষার প্রচলন থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য।
আমাদের দেশে কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থার সম্ভাবনা
কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষায় যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে আমাদের দেশে। কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণে কৃষিকাজে, কলকারখানায় কাজ পেতে সুবিধা হয় এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করা যায়। উচ্চতর প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষা অর্থাৎ, ভাষা, গণিত, সমাজ ও সাধারণ বিজ্ঞান শিক্ষা প্রচলিত থাকবে এবং তারপর উপযুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা উচ্চতর শিক্ষার উপযুক্ত ছাত্রদের বাছাই করে নিতে হবে।
অবশিষ্টরা নিজ নিজ প্রবণতা ও অন্তর্নিহিত গুণানুযায়ী বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষায় নিযুক্ত হবে। এভাবে মাধ্যমিক স্তর ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শেষেও বাছাই এবং অবশিষ্টদের গুণ ও প্রয়োজন অনুসারে বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের চাহিদা অনুযায়ী এভাবে সকল ক্ষেত্রের উপযুক্ত দক্ষ কর্মী পাওয়া যাবে। এতে কর্মমুখী শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করতে পারে।
কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি
আমাদের দেশ বিভিন্ন দিক থেকে অনগ্রসর এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন । কর্মমুখী শিক্ষাকে আমাদের দেশে কোনোরকম গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এ শিক্ষাকে তুচ্ছ বলে মনে করা হয়। সাধারণত অভিজাত শ্রেণি বা উচ্চ শ্রেণির অনেকে এমনকি মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরাও এ শিক্ষার প্রতি তেমন আগ্রহ দেখায় না। এ ধরনের মানসিকতা আমাদের সমাজ থেকে দূর করে কর্মমুখী শিক্ষায় মানুষের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে।
সাধারণ শিক্ষার চেয়ে বৃত্তিমূলক কর্মমুখী শিক্ষা যে বেশি উপকারী এই চেতনা সৃষ্টি করতে না পারলে আমাদের ব্যক্তি বা জাতীয় জীবনে উন্নতি ও অগ্রগতি সম্ভব নয় । রেডিও, টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা বা অন্যান্য প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে মানুষের মধ্যে এই চেতনাবোধ সৃষ্টি করতে হবে।
আরও পড়ুন :- বাংলাদেশের বেকার সমস্যা ও তার প্রতিকার : বাংলা প্রবন্ধ রচনা
কর্মমুখী শিক্ষার উপকারিতা
কর্মমুখী শিক্ষাকে ব্যাপকভাবে প্রবর্তনের ক্ষেত্রে নানারকম সমস্যা থাকলেও এর উপকারিতাকে অস্বীকার করা যায় না। কর্মমুখী শিক্ষার নানারকম উপকারিতা রয়েছে; যেমন : (ক) এ শিক্ষা অর্জন করলে বেকারত্বের অভিশাপ হ্রাস পাবে, (খ) সহজে কাজ পাওয়া যায়, (গ) উপার্জনশীল হওয়া যায়, (ঘ) ব্যক্তিস্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকে, (ঙ) সাধারণ শিক্ষার ওপর চাপ কমে আসবে, (চ) স্বাবলম্বী বা স্বনির্ভর হওয়া যায়, (ছ) জীবনের হতাশা, শূন্যতাবোধ এবং ব্যর্থতাজনিত গ্লানি থেকে মুক্ত হওয়া যায়, (জ) নতুন নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায় ইত্যাদি।
কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার
কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব আজ সর্বজনস্বীকৃত। এর মাধ্যমে হাতে-কলমে শিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা পেশাগত কাজের যোগ্যতা অর্জন করে এবং দক্ষ কর্মী হিসেবে কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয় । কর্মমুখী শিক্ষা প্রসার ও উৎকর্ষ সাধন ছাড়া কোনো জাতির কৃষি, শিল্প, কল-কারখানা, অন্যান্য উৎপাদন এবং কারিগরি ক্ষেত্রে উন্নতি সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে কর্মমুখী শিক্ষার ক্ষেত্র ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। দেশে প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, পলিটেকনিক ও ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট; লেদার ও টেক্সটাইল টেকনোলজি কলেজ, গ্রাফিক্স আর্টস কলেজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এগুলো কর্মমুখী শিক্ষা প্রসারে ভূমিকা রাখছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। তাই আমাদের দেশে সরকার ও জনগণের সক্রিয় প্রচেষ্টায় আরও কর্মমুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার।
বর্তমানে মাধ্যমিক স্তরে কর্মমুখী শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে স্কুল ও মাদ্রাসায় নবম ও দশম শ্রেণিতে বেসিক ট্রেড কোর্স চালু, কৃষিবিজ্ঞান, শিল্প, সমাজকল্যাণ ও গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত; পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ডবল শিফট চালু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ।
বৃত্তিমূলক /কর্মমুখী শিক্ষার শ্রেণিবিভাগ :
বৃত্তিমূলক বা কর্মমুখী শিক্ষা দ্বিবিধ। একটি হলো ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষিবিদ্যা, ওকালতি ইত্যাদি। এর জন্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রির প্রয়োজন হয়। অন্যটি হলো সাধারণ কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা। এ শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রির প্রয়োজন হয় না। সাধারণত প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক শিক্ষাই যথেষ্ট। যেমন- ধাত্রীবিদ্যা, সেলাই কাজ, কাঠ বা রাজমিস্ত্রির কাজ, দর্জি, বিদ্যুৎ, মেকানিক্যাল কাজ ইত্যাদি ।
সাধারণ শিক্ষা ও কর্মমুখী শিক্ষা :
যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানুষের জীবনে কর্মসংস্থানের সহায়ক হয়ে ওঠে তা-ই কর্মমুখী শিক্ষা। দেশের চাহিদা, শিক্ষার মান, শিক্ষার্থীদের মেধা, কর্মসংস্থান ইত্যাদির সাথে সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমন্বিত করতে পারলে সাধারণ শিক্ষাও কর্মমুখী হয়ে ওঠে। মূলকথা, মানুষের কর্মজীবনের উপযোগী শিক্ষাকেই সাধারণ অর্থে 'কর্মমুখী শিক্ষা' বলা হয় ।
কর্মমুখী শিক্ষার ক্ষেত্র :
কর্মমুখী শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মানুষের জীবিকার নিশ্চয়তা প্রদান এবং জীবন ও জগতের সাথে খাপ খাইয়ে চলায় মানুষকে উপযুক্ত করে তোলা। জীবনের প্রয়োজনীয় উপকরণ উৎপাদন ও সেবা নিশ্চিত করার বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সাথে বৃত্তি জড়িত। তাই বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্র বিস্তৃত। যেমন- কাপড় বোনা, কাপড় সেলাই, পোশাক ডিজাইনিং, বাটিক শিল্প, গাড়ি চালনা, যন্ত্রপাতি তৈরি ও মেরামত, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি প্রস্তুত ও মেরামত, দালান-কোঠা নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, কাঠ ও লোহার আসবাবপত্র তৈরি, মুদ্রণ-সংক্রান্ত কাজ,
তথ্য যোগাযোগ সঞ্জাত কাল, কম্পিউটার অপারেটিং, ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান, রঙের কাজসহ আরও অসংখ্য ক্ষেত্র আছে যেখানে বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতার সাহায্যে সহজেই কর্মসংস্থান করে নেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে পেশাগত উৎকর্ষ অর্জন ও সম্মানের সাথে কর্ম পরিচালনার যথেষ্ট সুযোগ বিদ্যমান। তাছাড়া সাধারণ শ্রমিকের চেয়ে এসব ক্ষেত্রে পারিশ্রমিক যেমন বেশি তেমনি কর্মের নিশ্চয়তাও বিদ্যমান। আজকাল মৎস্যচাষ, হাঁস- মুরগি পালন, পৰাদি পশু বর্ধন, ডেইরি প্রভৃতিও কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ।
প্রচলিত শিক্ষার ত্রুটি :
বর্তমান প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় বাস্তবতা বর্জিত সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত থাকায় ডিগ্রিধারী শিক্ষিত বেকার তৈরি হচ্ছে। ফলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, যন্ত্রবিজ্ঞানী তৈরি হচ্ছে না।
কর্মমুখী/বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ :
আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হাতে গোনা। বাংলাদেশের প্রধান কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় হলো ঢাকার বাংলাদেশ প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর রয়েছে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। মহাবিদ্যালয়গুলোর মধ্যে হলো রাজশাহী ও চট্টগ্রামের প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়। মাধ্যমিক পর্যায়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে ।
কর্মমুখী শিক্ষার জন্য আনুষ্ঠানিক ও সরকারি উদ্যোগ :
বাংলাদেশের সরকারি পর্যায়ে তিন ধরনের কারিগরি শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। যেমন : ক. ডিগ্রি পর্যায়, খ. ডিপ্লোমা পর্যায় ও গ. সার্টিফিকেট পর্যায়। ডিগ্রি পর্যায়ে প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদ তৈরি করা হয়, ডিপ্লোমা পর্যায়ে টেকনিশিয়ান তৈরি করা হয় এবং সার্টিফিকেট পর্যায়ে দক্ষ কারিগর ও কর্মী তৈরি করা হয়। ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশলী ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।
এর পরবর্তী পর্যায়ে আছে ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে চারটি প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়। বস্ত্র ও চর্মজাত শিয়ে ডিগ্রি প্রদানকারী দুটো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যার একাডেমিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে। ডিপ্লোমা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট সংখ্যা ২৩টি। এর মধ্যে বহুমুখী ২০টি ও বাকি ৩টি একমুখী কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
এগুলো কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর কর্তৃক পরিচালিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠান সরকারি উদ্যোগে কারিগরি বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ প্রদান করে থাকে। তাছাড়া সার্টিফিকেট প্রদানকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আছে ৫১টি। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান থেকে যে সংখ্যক শিক্ষার্থী বের হয় তার সংখ্যা প্রয়োজন অনুযায়ী যথেষ্ট নয়।
উপসংহার
বাংলাদেশ বিপুল জনসংখ্যার দেশ। কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে এ জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব। দক্ষ জনশক্তি দেশের সম্পদ, উন্নয়নের চাবিকাঠি। তাই আমাদের দেশে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ব্যাপকভাবে কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটানো দরকার।